বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৩

বাবার চোখের শেষ জল!

ছুটিতে বাড়িতে আসলেই আব্বা, আমি, ছোট ভাই, বড় বোন এই চারজন মিলে লুডু খেলতে বসতাম। আমার সঠিক বয়সটা মনে নেই। তবে প্রাইমারী স্কুলে পড়াশুনার সময়টায়ই হবে। আমি সেই লুডু খেলায় প্রতিবারই চতুর্থ হতাম! আমার ছক্কা উঠতো না। যাও উঠতো আমাকে সবাই মিলে আমার গুটি কেটে একাকার করে ফেলত! আমিও ছিলাম সেরকম একজন! হাউমাউ করে চিৎকার করে কাঁদতাম। তারপর আব্বা ঘোষণা দিল কেউ সুধার গুটি কাটবি না! আমার গুটির উপর কারো গুটি এসে পরলেও আমার গুটি কাটা হয়েছে বলে ধরা হতো না! (হা হা হা হাসি পায় এখন) তারপর ও আমি সেই আগের অবস্থানেই থাকতাম! আমাকে অনেক সুবিধা দিয়ে দুই গুটি দিয়ে খেলায়ে প্রথম বানায়ে আব্বা লুডু খেলা শেষ করতেন! এরপরও না পারলে সাপ লুডু খেলা শুরু করতো আব্বা। হা হা হা… ৯৩ তে এসেই তিন-এ নেমে আসতো  আমার গুটিটা। অজগড় সাপ খেয়ে ফেলত! আমার জেতা হতোই না! তবে আব্বার সেই চেষ্টা আমার কান্না থামানোর সেটি আজো মনে পরে। তারপর একটি পাতানো ম্যাচ হতো যেটায় আমি জয়ী হতাম-ই।
লুডু শেষ, দাবা খেলি চলো মা। ওখানেও আমি গাধী এমন চাল দিতাম যে হারু পার্টি হয়ে দাবার গুটি গুছিয়ে কাঁদতাম আর বলতাম আপনারা এমন কিছু একটা করেন যেটা আমি বুঝি না। তাই আমি সব খেলায় হেরে যাই। আব্বা হাসত বাকি ভাই বোনরাও।
আব্বা ছোট বেলায় আমাকে খুব খেপাতও বলতো সুধা তো আমাদের মেয়ে না ! আমরা তো ওকে হযরত শাহজালাল (রহঃ) এর মাজার থেকে কুড়িয়ে এনেছি। কারন আমার জন্ম হয়েছিল সিলেটে। আমি কি যে কান্না করতাম। আমি উনাদের মেয়ে না- এটা মানতে চাইতাম না।
যেহেতু আমি পরিবারের চতুর্থ মেয়ে তাই আম্মাকে সাহায্য করতে কোন কাজ করতাম না। যদিও কিছু একটা করতে বলতো, সাথে সাথে আমার উত্তর ‘পারতাম না’! আব্বা একসময় আমাকে শিখাল মা তোমার এক কথা আর শুনতে ভালো লাগেনা! তুমি একটা কাজ করো আজ থেকে বলবা ‘পারবো কিন্তু করবো না’! (এখন খুব মজা লাগে)
আমরা গ্রামে থাকতাম আর আব্বা নানা জেলায় ঘুরে বেড়াতেন চাকরীর সুবাদে। আব্বা যখন বাড়ি আসতেন তখন আমার লক্ষ্য থাকতো আব্বার ব্যাগ। কি আছে আমার জন্য! জামা? হ্যাঁ সুধার জন্য আনতেই হবে এবং আব্বা আনতেন। তাঁর পাগল মেয়ে ছিলাম আমি। আমি যখন আব্বার ব্যাগ তল্লাশি করতে বেপরোয়া তখন বাকী সবাই আব্বাকে কি খাওয়াবে কি করবে এ নিয়ে তাড়াহুড়া।
আমাদের সব ভাই বোন আব্বাকে ভয় পেত। এমন কি বাড়ির সবাই এলাকার সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা করতো! কিন্তু আমি দুষ্টু, আব্বাকে ভয় পেতাম না। ভয়ঙ্কর দুষ্টু আমি একটা ঝামেলা পাকায়ে ছোট ভাই বোন কিংবা সেজো বোনের ওপর চাপায়ে দিতাম ! আর আব্বা এমন ধমক দিতেন যে সহসা ঘরে ফেরার সাহস করতো না! আব্বা আমাদের কখনো গায়ে হাত তুলে, লাঠি পেটা করেও মারেন নি, কঠোর শাসন করেন নি।
স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় আমি বরাবর ফার্স্ট হতাম এবং আমার আব্বা আমাকে চমকে দিয়ে একটি উপহার নিয়ে আসতেন এবং সেই উপহারের মধ্যে ছিল প্লাস্টিকের মরিচ গাছ, একটি কাঁসার বাজ পাখী। আব্বা ওটার গায়ে আমার নাম লিখিয়ে এনেছিলেন। আর মনে পড়ছে না। আব্বার উপহার গুলোর সব কিছুই রয়েছে আমার কাছে।
আব্বার জমিতে কেউ ঝামেলা করছে , ফসল নষ্ট করছে কিংবা যারা জমিতে কাজ করেন তারা ফাঁকি দিবেন? অসম্ভব! সুধা মাঠে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে সব গুছিয়ে নিয়ে আসবেই! আর আব্বা ঘরে শুয়ে থাকতেন। উনি রোদে থাকতে পারতেন না। তাই কখনও জমিতে গেলে মাথায় ছাতা দিয়ে যেতেন! আমি ব্যঙ্গ করে বলতাম, ‘ঐ যে সাহেব এসেছেন’!
১৯৮৯ সাল। আব্বা বান্দরবান চাকরি করেন। আমি ও ছোট ভাই মিলে আব্বার কাছে গেলাম। আব্বার চাকরী স্থান বদলেছে। একজন আব্বাকে এসে পাহাড়ি কলা দিয়ে গেলেন এক ছড়া। আমি এবং আমার ছোট ভাই মিলে ঐ কলাগুলো সকাল থেকে বিকেলের মধ্যেই শেষ করে ফেললাম! আব্বা অফিস থেকে এসে দেখে ‘কলা নেই’! অবাক হয়ে বলল কি যে করছ তোমরা কি হবে আল্লাহ জানে! সেরকম কিছুই হয়নি। কলাগুলু ওমনি বের হয়ে গেছে পেট থেকে। হজমও হয়নি। হি হি হি ।
আব্বা উনার চাকরী জীবনের শেষ কর্মস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কুমিল্লা বার্ড (কোটবাড়ি)। সেখানেও আমি গিয়েছিলাম। একটানা  একমাস থেকেছি আব্বার সাথে। দুষ্টু ছিলাম, তবে বুঝতাম না আব্বা কোন স্তরের একজন সরকারী কর্মকর্তা। আব্বা আমাকে উনার অফিসের রুমে বসিয়ে ক্লাসে গেলেন। আমি তো আব্বার চেয়ারে বসে দেখি একটি কি যেন সুইচ টাইপের কিছু! ভাবলাম কি আর হবে মারি টিপ! টিপ দিলাম ক্রিং ক্রিং বেজে উঠলো! খাইছে এটা তো কলিং বেল। পিওন হাজির। বললাম কিছু লাগবেনা চলে যান। সেদিন প্রথম জানতে ও বুঝতে পারি আব্বা ‘প্রথম শ্রেণীর একজন গেজেটেড কর্মকর্তা’ আনন্দে বুক ভরে গেল। আমার আব্বা এত ভালো চাকরী করেন!
পুরো কোর্টবাড়ি আমি চষে বেড়াতাম একা একা। আমি যেন ওখানকার রানী! কারন রেজা স্যারের মেয়ে। গাছ থেকে আম পেরে খাওয়া, সফেদা পারা, বেল গাছের বেল, উফ আরো কতো কি!
আব্বা ওখানেই চাকরী করার সময় আমার এক বোনের বিয়ে হল। আর কি বাগানের ফুল চুরি করে গায়ে হলুদের সকল আয়োজন করেছিলাম। পুরো বার্ড জুড়ে আমাদের বিয়ে বাড়ি তৈরি করে অসাধারন একটি উৎসবে মেতেছিলাম সেদিন। বোনের বিয়ের দিন আব্বার চোখে প্রথম জল দেখেছিলাম !
তার কিছুদিন পরই আব্বা সরকারী চাকরী থেকে অবসর গ্রহন করলেন। গ্রামে চলে গেলেন আম্মার কাছে। আব্বা গ্রামীণ জীবনটা খুব পছন্দ করতেন! বলতেন গ্রাম কতো বড় এলাকা নিয়ে! ‘আমার ভিটে মাটি’ বলতে খুব স্পর্শ কাঁতর ছিলেন! প্রতি বছর নিজের তৈরি টিনের ঘরটিকে রঙ করতেন, মেরামত করতেন। যুদ্ধের আগে বা পরে ঘরটি তৈরি করেছিলেন। অনেকেই বলেছিলেন, টিনের ঘরটি বদলীয়ে দালান তৈরি করতে। আব্বা রাজী হননি।
আমি কলেজ পড়ার সময় কলেজের ইনডোর এবং আউটডোর সব কিছুইতেই অংশগ্রহন করতাম। পারি আর না পারি! মেয়েদের মধ্যে দৌঁড় প্রতিযোগিতায় আমি কোন পুরস্কার তো পেলাম-ই না উল্টো তাকিয়ে দেখলাম আমার পিছনে কেউ নেই। আমি লাস্ট। আব্বা বললেন ‘মা তুমি পিছন দিক থেকে ফার্স্ট হয়েছ’! আজো সেই কথাটি আমার মনে গেঁথে আছে আব্বা কতো সুন্দর করে আমাদের খারাপ মনে ভালো করে দিতেন!
আব্বা গ্রামে যাওয়ার কিছুদিন পর আমার মেঝো বোনটি মারা যায়! তখন ওর বয়স ২০/২৫ হবে! সেদিন দ্বিতীয় বারের মতো  আব্বাকে কাঁদতে দেখলাম! তবে হাউ মাউ করে নয়! চোখ দিয়ে পানি পরছিল আর ঠোট কামড়ে ধরছিল থেকে থেকে।
আমি চাকরী নেয়ার পর প্রথম বেতন দিয়ে ঈদে কিছু কিনে দিব আম্মা আব্বাকে! আব্বার অনেক শখ ছিল একটি আড়ং-এর পাঞ্জাবী। আমি আব্বার জন্য একটি সিল্ক-এর পাঞ্জাবী আর আম্মার জন্য শাড়ি কিনলাম আড়ং থেকে। হি হি ঈদের দিন আব্বা সেই ক্রিম রঙের পাঞ্জাবীতে পান খেয়ে পিক ফেলে লাল করলেন! গ্রামে ধোপার কাছে দিয়েছিল পরিস্কার করতে। ঐ ব্যাটা আব্বার পাঞ্জাবী ছিঁড়ে কুটি কুটি। আব্বা আমার ভয়ে ছিলেন। মেয়েটা আমাকে দিল এত শখ করে আর আমি কি করলাম!
আমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আব্বা যত বার আমার বাসায় বেড়াতে আসতেন এবং নতুন কিছু পণ্য দেখতেন তখনই আব্বা বলতেন ‘তোর আম্মা এমন একটি জিনিস আমার কাছে অনেকদিন যাবত চাচ্ছিল’! হেসে বলতাম, আব্বা আম্মা চায়নি, ‘আপনি আম্মার জন্য কিনবেন সেই জন্য নিবেন সেটা বলতে লজ্জা পাচ্ছেন’ ! আব্বা বাড়ি যাওয়ার সময় আম্মার জন্য কতো কি যে কিনে নিতেন হিসাব নেই ! লুকিয়ে লুকিয়ে কিনতেন। কারন আমরা আব্বাকে লজ্জা দিতাম। ইস বুড়া বয়সে প্রেম দেখো।
আব্বা আপনি কি আপনার বউ এর সাথে ফোনে কথা বলবেন? নাহ বলব না! তোরা ফোন করে আমাকে জানা কেমন আছে, কি করছে! কিংবা একটু ভালো খাবার যা গ্রামে পাওয়া যায় না সেটা খেতে দিয়েই বলতে হতো ‘আব্বা আপনি খান, যাওয়ার সময় আম্মার জন্য দিয়ে দিবো’! আব্বা মিটি মিটি হাসত !
আম্মা আব্বাকে অনেক জোর করে আমি ঢাকায় নিয়ে এসেছিলাম ২০০৯ সালে। বাসা খুঁজে সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়েছিলাম আমি একা একা। মাঝে মাঝে ছোটো বোন সাহায্য করেছিল। আমার জীবনের লক্ষ্য একটাই আমার সাধ্যমত আব্বা আম্মাকে সুখ দেয়া, আনন্দ দেয়া। সম্পূর্ণ আর্থিক, শারীরিক সামর্থ্য দিয়ে আমি আব্বা আম্মার জন্য জীবনের শুরু থেকেই লড়ে গেছি।
আব্বা আম্মা ঢাকা আসার পর আমার বড় আপা ঠিক করলেন আম্মাকে তার কাছে আমেরিকা নিয়ে যাবেন। কিছুদিন পর আব্বাকে নিয়ে যাবেন! আব্বার উত্তর আম্মাকে ‘তুমি যাবা না’! আপার পিড়াপীড়িতে আব্বা রাজী হল ‘আম্মাকে বলল তুমি যাও’! দূরে গিয়েই দেখি আব্বা কাঁদছে! এটাই আমার দেখা আব্বার চোখের শেষ জল!  কেন? আম্মা চলে যেতে পারে এই আতঙ্কে, চিন্তায়! কিন্তু আম্মা তখন যাননি এবং আপাও নিয়ে যান নি !
২০১০ সালের ১১ অগাস্ট সন্ধায় আমি অফিস থেকে বাসায় ফিরছি এমন সময় ছোট বোন আমাকে ফোন দিল ‘সুধা আপা, আব্বা খুব অসুস্থ হয়ে গেছে তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় আসো’! আমি দৌড়ে বাসায় গেলাম! গিয়ে টাকা নিলাম ! ততক্ষণে বোন ক্ষেপে গেছে তুমি আস না কেন সুধা আপা? আমি দৌড়ে ‘মিরপুর আল হেলাল হাসপাতাল গেলাম’ ! জরুরী বিভাগে আব্বাকে রাখা হয়েছে! দৌড়ে গিয়ে দেখি ‘আমার আব্বা চিরতরে ঘুমিয়ে গেছেন’! আব্বার এই হুট করে চলে যাওয়া আমি আজও মানতে পারি না!
১২ অগাস্ট ২০১০ সালে গ্রামের বাড়িতে আব্বাকে দাফন করা হয়। আগের দিন সন্ধ্যায় যে মানুষটি চলে গেছেন পরদিন ভোর বেলায় দেখে মনে হচ্ছে তিনি শুধু ঘুমাচ্ছেন। শুধু তাকিয়ে দেখলাম কি পবিত্র একটা চেহারা। কোন ছাপ নেই!
আব্বা একদিন কেঁদেছিল যদি আম্মা আব্বাকে ফেলে আমেরিকা চলে যায় তাহলে কি করে একা একা থাকবে! এতো ভালবাসার মানুষ আমাদের আম্মাকে একা করে দিয়ে আব্বা নিজেই চলে গেলেন। কোনো সুযোগও দিলেন না তাকে আটকে রাখার চেষ্টা করার। আব্বা নেই আম্মা যে কি করে দিন কাটায় আমি কেবল দেখি আর অনুভব করি আমার আম্মাকে! (আমার আম্মা আব্বাকে তুমি নয় আপনি আপনি সম্বোধনে কথা বলতেন। আমি আম্মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আম্মা কেন আব্বাকে ‘তুমি’ বল না? উত্তরে আম্মা বলেছিলেন – তোর আব্বাকে যেদিন প্রথম আমি দেখি সেদিন আমার থেকে বয়সে অনেক বড় মনে হয়েছিল তাই তুমি বলতে পারি নাই!)
আম্মাকে আমি এই প্রশ্নটাও করেছিলাম – আম্মা আমরা যে পর পর চার বোন জন্মগ্রহন করেছি সেটা নিয়ে আব্বা কিছু বলেন নি আপনাকে? উত্তরে আম্মা বলেছিলেন – তোর আব্বা তোদেরকে এতো যত্ন করতেন যে বলা বাহুল্য। উনার কাছে ছেলে মেয়ে আলাদা কিছু ছিল না। আমি কেবল ছেলে ছেলে করে ছয় জন ছেলে মেয়ের বাবা মা হলাম! আমার আব্বা সব সময়ই বলতো ‘আমার মেয়েরাই আমার আসল পরিচয় আমার ছেলের কাজ করেছে’!
আমি আব্বাকে মন ভরিয়ে দিতে পারলাম না এটা আমাকে খুব কাঁদায়! কষ্ট দেয় যখন আব্বার অনেক শখ এখনো মনে পরে। এখন আল্লাহ আমাকে আর্থিক সামর্থ্য দিয়েছেন কিন্তু কেড়ে নিয়েছেন আমার আব্বাকে! কার শখ আমি আর পূর্ণ করবো? ইস আব্বা যদি আর একটা বছর পর আমাদের ছেড়ে যেতেন !
আমার ছেলেকে কোন নামে ডাকবে সেটি কিন্তু আমার আব্বা ঠিক করেছিলেন। কারন আমি আলাদা ডাক নাম রাখিনি। আব্বা নামের হাসিন অংশটাই চূড়ান্ত করলেন এবং কেমন করে যেন সবাইই ডাকা শুরু করলো! আব্বা ডাকার পর থেকে।
ইদানিং থেকে থেকে আব্বাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করে। খুব কথা বলতে ইচ্ছা করে। মাঝে মাঝে দেখি আব্বা হেঁটে বেড়াচ্ছে। হাসিনের সাথে গল্প করছে, আমার ছেলেটা নানা ভাইকে ধরে মারত, দাড়ি ধরে টানতো আব্বা কষ্ট পেতনা দেখে আমি রেগে যেতাম! বলতাম আব্বা হাসিন কিন্তু বেশি বেশি করছে। ‘আব্বা বলতেন চুপ থাক আমার ভালো লাগে’! হাসিন মাইর দিতো আর আব্বা সেই স্বর্গ সুখে চিৎকার করতেন “ সুধারে সুধা তোর ছেলে আমাকে মাইরা ফালাইলরে “ !
ভুলতে পারিনা আব্বার সেই কথাগুলু! ‘সুধা আমার ছেলে’ ‘মা বল পারবো কিন্তু করবো না’! আব্বা আমার ছেলেকে নিয়া গাওয়া সেই গান এখনো আমার কানে বাজে ‘হাসিন রে কইরা মোবাইল ফোন/ বারে বারে মিস কল দিয়া জালাইস না আগুন’! আমার ছেলেটাকে নিয়ে আব্বা তিন ওয়াক্ত নামাজ পরতেন মসজিদে! আমার ছেলেকে আব্বা ‘সুরা ফাতিহা’ শিখিয়েছিলেন !
এখন অনেক সুরা আমার ছেলে জানে ! কিছুদিন আগে আব্বার কবরের পাশে গিয়ে হাসিন আমাকে  – এখানে নানাভাইয়ের বুক, এখানে পা, এখানে মাথা বলে পুরু কবরটা হাতালো, আদর করলো ! আর বলল আম্মু আমি যদি সব গুলু সুরা পরি তবে কি নানা ভাই শুনতে পাবে ? বললাম হ্যাঁ বাবা তুমি সুন্দর করে বল নানা ভাই ঠিক শুনতে পাবে !
আব্বা আমার জন্মদাতা পিতা আমাদের মাঝে আর কোনদিন জীবন্তভাবে ফিরে আসবেন না! স্মৃতি হয়ে, স্বপ্নে আসেন, আসবেন,আছেন । আব্বার ছবি দেখি। জন্মদাতা আব্বা নেই আমার। কিন্তু আব্বাকে মাঝে মাঝে দেখতে খুব অস্থির লাগে। মানতে ইচ্ছে হয় না আব্বা আর ফিরে আসবে না!
আমি জন্ম দিয়েছি আরেক আব্বা ! আমার সন্তান, আমার ছেলে! তাকেই এখন মনে ভরে প্রাণ ভরে আব্বা, বাবা, বাবুজি, আব্বুজি, আর কতো কিছু বলেই ডাকি।
কিছুদিন আগে যখন গ্রামে গেলাম গিয়ে দেখি আমাদের বেড়ে উঠার সেই ঘরটি একা একা দাড়িয়ে আছে! আব্বা নেই, যত্ন নেই! ঘরের ভিতর ময়লা আর মাকড়সার জালে আবৃত! খুব কষ্ট হল। আব্বা যে বিছানাটিতে ঘুমাতেন সেটি খালি ময়লা হয়ে পরে আছে! বিছানার পাশেই রয়েছে বৈদ্যুতিক বেড সুইচটা। আব্বার পান খাওয়ার ড্রয়ারটা। আব্বার প্রিয় বৈদ্যুতিক ফ্যান। সব কিছুই কেমন যেন মলিন হয়ে গেছে। যেই টিভিটা সারাদিন চলতো সেটি এখন আর কেউ চালানোর জন্য নেই!
আমার ভাই এখন ভাবছে আব্বার তৈরি টিনের ঘরটি বিক্রি করে একটি ইট বালি দিয়ে তৈরি করবে আধুনিক দালান। কারন একটি আস্তে আস্তে ভেঙ্গে পড়ছে! রক্ষনাবেক্ষণ করার কেউ নেই।! ভাবতে পারিনা! কিন্তু আব্বা নেই নির্মম সত্যিটি নিয়ে তো বেঁচে আছি। তেমনি আব্বার তৈরি আমাদের গ্রামের সেরা টিনের ঘরটি ভেঙ্গে দালান বানালেও মেনে নিতে পারবো। আব্বার স্মৃতি তো কেবল একটি টিনের ঘরেই সীমাবদ্ধ নয় তাই এভাবেই নিজেকে তৈরি করে আব্বার ভুমিতে তৈরি করা নতুন ভবনটি নক্সা আমি নিজেই করছি। যেখানে থাকবে আব্বা আম্মার কিছু পছন্দ।
আমার আব্বাকে আল্লাহ বেহেস্ত নসীব করুন! আব্বাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে খেয়াল করলাম আমার আব্বার সাথে আমার কতো স্মৃতি। আব্বা আমার ভিতরে কতোটা জুড়ে আছে! আব্বা আপনি চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে, কিন্তু চলে গিয়েও আমাদের মধ্যেই বেঁচে আছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছেন সর্বক্ষণ!
আব্বা আপনি এই পৃথিবীর একজন সফল মানুষ। আপনার সন্তানেরা কেউ আপনাকে অশ্রদ্ধা করেনি, করছে না, ইনশাল্লাহ করবেও না। কেবল আমাদের জন্য দোয়া করবেন ! হাসিন জানতে চায় আকাশের কোন তারাটা নানা ভাই? নিজেই বলে ‘যেই তারাটা বড় এবং জ্বলজ্বল বেশি করছে সেইটাই আমার নানা ভাই’!  
 আপনার সুকন্যা সুধা রেজা অনেক ভালবাসে আপনাকে। আমার আব্বা আছে, ছিল, যুগযুগ ধরেই আমার মাঝে ‘স্বাদের লাউ বানাইল মরে বৈরাগী’ ওই গানটির মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকবে। গানটি আপনি অসাধারন গাইতেন!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন