বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৩

চলতি পথে হঠাৎ থামিলাম! (বিড়ম্বনা-৩)

আমেনা, বয়স ১৩/১৪ হবে। একটি সুন্দর স্কার্ট আর প্যান্ট পরে ফর্সা টুকটুকে মেয়েটি একটি পুটলি হাতে নিয়ে আমার বাসায় চলে এল জীবিকা নির্বাহের জন্য। তখন আমি ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা! মেয়েটিকে এই জন্যই আমার দরকার ছিল। কারন মা হবো, চাকরি করি তাই সব মিলিয়ে একজন সহযোগী দরকার। খুব সুন্দর মিষ্টি মেয়েটি। লক্ষ্মী কুটকুটই। খুব মায়া লাগতো। এপ্রিল মাসের ২৭ তারিখ আমার বাসায় আসলো আমেনা আর মে মাসের ১৭ তারিখ আমার পুত্র হাসিন জন্ম নিলো। আমি তখন বারডেম হাসপাতাল এ ভর্তি। খুব সুন্দর করে আমেনা আমার সংসারটা সামলে নিলো!
বাসায় ফিরলাম ছেলেকে নিয়ে। এই বয়সী মেয়েটির কাছে রেখেই আমি দিব্বি চাকরীতে জয়েন করলাম নির্ভয়ে। আমেনা আমাকে ভাবি বলে ডাকত। আমিও ওকে তুমি করে বলতাম। কারন তুই তকারি কিংবা তাচ্ছিল্য করতে আমার ভালো লাগেনা।
যখন যেখানে বেড়াতে ঘুরতে গিয়েছি সাথে করে নিয়ে যেতাম। নিজে যা খেতাম তাই ওকে খাওয়াতাম আর বলতাম শুন রে বিয়ের পর জামাই কোথাও নিয়ে যাবেনা। তখন এই ভাবিকে মনে করবি! যত শখ আছে পূর্ণ করে যাও সোনা বোন আমার। আমার ছেলেটির TWINKLE TWINKLE LITTLE STAR  ছড়াটি আমেনার কাছ থেকেই শিখা ! কিংবা ক খ গ !
এভাবে আমেনা ৩.৫ বছর থেকে আমার কাছ থেকে ৬ মাস পূর্বে জানিয়ে তারপর বাড়ি চলে গেল একবারে। বাবা বিয়ে দিবে। মেয়ে বড় হয়েছে। বড় ছেলে বিদেশ চলে গেছে। টাকা পয়সা আসছে ঘরে। সব মিলিয়ে এই সিদ্ধান্ত হল। আমিও যেতে দিলাম বুক ভরা ভালোবাসা আর দোয়া দিয়ে।
আমেনার বিয়ে হল, সংসার হল। এখন আমেনা নিজেও একজন ছেলের মা। মেয়েটির সাথে আমার যোগাযোগ আছে ছিল, থাকবে। অদ্ভুত হল আমার ছেলে ক্লাস ওয়ানের ভর্তি পরীক্ষায় ফুফুর নামের জায়গায় আমেনার নামটি লিখে দিয়ে এসেছিল। এবং পাশের সকল বন্ধুরা ফুফুর নাম আমেনা লিখেছিল!
কিছুদিন আগে আমি আমার ছেলে ও ছোট বোন গেলাম ধানমণ্ডির রাইফেল (বর্তমান সীমান্ত ) স্কোয়ারে। হেলভেশিয়ায়  ঢুকলাম খেতে! আমাদের পাশে বসেছেন একজন উচ্চবিত্ত মহিলা, তার ৪/৫ বছরের মেয়ে এবং কাজের সহযোগী মেয়েটি। উল্লেখ্য, মা মেয়ের কাপড় চেহারা দেখে বুঝা গেল বেশি টাকাওয়ালা পরিবার থেকে আসা! অবাক লাগলো যখন দেখলাম ভদ্র মহিলা চিকেনগুলু খাওয়ার পর হার এর সাথে লেগে থাকা অল্প স্বল্প মাংশ যা আমরা ফেলে দেই সেগুলু মেয়েটাকে খেতে দিয়েছে! ছোট মেয়েটি সেই হারগুলু বসে চিবোচ্ছে!
এরই ধারাবাহিকতকায় আমেনার ছোট বোন আকলিমা ২০১১ সালের ডিসেম্বের মাসে আমার বাসায় আসে। আজ অবধি আছে! কেবল বলে ভাবী যাব না আপনার বাসা ছেড়ে! বিয়ে লাগবে না! কেন বলে জানি না! আমার বাসায় গৃহ পরিচারিকা নির্যাতন আইন আছে! আমি ছাড়া কেউ ওঁকে ধমক কিংবা শাসন করতে পারবে না। আর আমার শাসন হল “ভাবী  তুমি একটি চাকরি করো মনে রাখবা! কাজের মেয়ে ভাব্বানা না! তোমার যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি করো তুমি ‘তাই দায়িত্বটা ঠিক মতো পালন করবে’! আর আমার চাওয়াগুলু বারবার বলতে চাইনা! যদিও প্রায়শই আমাকে এই লেকচার দিতে হয় তারপরও এর থেকে বেশি কখনই পারিনা পারতে চাইনা।
বন্ধু সুলভ আচরণ। আমার ছেলে ‘বন্ধু ফুপি’ বলে ডাকে! আমিও আমার সাথে এক সঙ্গে টেবিল বসেই খেতে দেই। টি ভি দেখা, গল্প করা, এমনকি জামা কাপড় কিনতেও ভালো দোকানে নিয়ে যাই আমার সামর্থ্য অনুযায়ী।
মেয়েটিও আমার ছেলেকে সুরা, কালাম শিখায়। কওমি মাদ্রাসায় পরাশুনা করে আসা একটি মেয়ে।
যারা আমাদের বাসায় কাজ করতে আসে আমরা তাদের ‘কাজের মেয়ে বলি’! কিন্তু আমরা যখন চাকরি করি অন্যের অধীনে তখন আমি হয়ে যাই ম্যাডাম কিংবা আপা! কিন্তু ঐ গরিব ছোট মেয়েটি তিন বেলা একটু ভালো খেতে, থাকতে পরতে আর সুন্দর একটি ভবিষ্যৎ গড়তে ১২/১৪ কিংবা তার থেকেও কম বয়সে বাবা মা ভাই বোন আপনজনকে ছেড়ে আমাদের কাছে আসে। আর আমরা তাদের ভুলের জন্য জীবন কেড়ে নিতেও দ্বিধা করি না!
আমার বান্ধবীর বাসার কাজের সহযোগি মেয়েটি চুরি করে খেয়েছে। মহাঅপরাধ তাই জিভ বের করে গরম খুন্তির ছেঁকা দিয়েছে! যেন আর খেতে না পারে এবং কেউ দেখতেও না পায়! কিন্তু মেয়েটি চুরি করে কেন খেলো? স্বভাবগত কারন? তাহলে বাদ দিয়ে দাও অথবা বুঝাও কিংবা পর্যাপ্ত খেতে দাও আর চুরি করে খাবে না।
এক আত্মীয়ের বাসায় গেলাম। কাজের সহযোগী মেয়েটির মাথার চুল ছোট ছোট করে কাটা ! বয় কাট! কি রে তর চুল এমন করে কাটা কেন? বলে, খালাম্মা কেটে দিছে, তেল লাগে, সাবান লাগে বেশি তাই!
টুকরা কাপড় জোড়া দিয়ে দিয়ে জামা বানিয়ে দেয়া নতুন কিছু নয়। খাবারের পরিমান একটি নির্দিষ্ট প্লেটে দিয়ে পরে আর না দেয়া অমানবিক দৃশ্য অহরহ!  ছেলে মেয়ের নিজের পুরান কাপড় আর ঘরের পচা, বাসি খাবারগুলুর জন্যই তোঁ একজন কাজের মেয়ে/ছেলে দরকার! এমন ধারনা হিসাব করেই অনেক গৃহিণী বাসায় কাজের মানুষ রাখেন।
কারো মেয়ের বা ছেলের গায়ে হাত তোলা কিংবা তাকে হত্যা করার কোন অধিকার আমার নেই। নিজের প্রয়োজনে ডেকে এনে হত্যা, নির্যাতনের ফলে এখন আর আমরা গৃহকর্মী পাইনা! ভুল করলে শুধরে দিতে হত্যা করতে হয় না কিংবা জ্বালিয়ে দিতে যে হয় না সেটি কিন্তু আমরা আমাদের সন্তানদের দিয়েই বুঝাতে পারি!
গৃহ পরিচারিকা নির্যাতনমূলক কোন খবর টিভি দেখলেই আমার বাসার মেয়েটি চিৎকার করে বলে, আল্লাহ বাঁচাইছে আমাকে! কিংবা আমি নিজেই লজ্জা পাই আমার মতোই একজন নারী কি করে এসব পারে? নির্যাতনে যারা মারা যাচ্ছে কিংবা আহত হচ্ছে তাদের পরিবার এত দুর্বল থাকে যে একটি সামান্য অঙ্কের টাকা পেলেই মেয়ে/ছেলের লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়! কি নিষ্ঠুর নিয়তি! নিরবে কাঁদে কেউ আবার সাহস করে পাঠায় “রাখে আল্লাহ মারে কে?”
বাসার কাজ ছেড়ে বেছে নিয়েছে গার্মেন্টস জীবন! কিন্তু সেখানেও এখন নিরাপত্তাহীন জীবন শুরু হয়েছে এই নিরপরাধ মানুষগুলুর। এরা যাবে কোথায়? কি করে খাবে? বাসায় কাজ? গার্মেন্টসে? না কোথাও না! এদেরকে ভিক্ষা করতে হবে নইলে না খেয়ে মরতে হবে পরিবারের সকলকে এক সাথে! হতভম্ব হতে হয় দায়িত্বশীলদের দায়িত্ববোধ দেখে!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন