বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৩

হোয়াট ইজ গুড ফুড? খাবারে বিষ!

‘মিল্ক ইজ এন আইডিয়াল ফুড’ এই কথাটি ছোট বেলায় সর্ব প্রথম শিখানো হয় বাচ্চাদের। আদর্শ খাবারের একটি তালিকা সম্পর্কে পড়াশুনার একটি টপিকস এ থাকে।
ডিম নিয়েও শুনা যাচ্ছে কৃত্রিম উপায়ে কেমিক্যাল দিয়ে ডিম তৈরি করে চীন নানা দেশে বাজারজাত করছে! এ নিয়া ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ সাইট এ লিখালিখি হয়েছে এমন কি উক্ত ডিম উৎপাদনকারী কোম্পানির ওয়েব পেজও দেখেছি যেখানে কি কি ধাপে ডিম তৈরি করা হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে দেখান ও বলা আছে এবং তাদের এই ডিম যদি কেউ ক্রয় করতে চায় তবে যোগাযোগের মাধ্যমটিও দিয়ে দেয়া হয়েছিল।! ( চায়না ফেক এগ )
একটি সময় ভারত থেকে কচ্ছপের ডিম এনে আমাদের দেশে হাঁসের ডিম বলে বিক্রি করা হয়েছে। কিন্তু এখনও সেই কাজ হচ্ছে কি না সেটা আমাদের জানা নেই। সাধারনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকেই খাবারে মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে বিষ!
সম্প্রতি হামলা করেছে ”গোলা নামের আইসক্রিম” যেটি এখন পুরো ঢাকা শহর ছেয়ে গেছে! এদের বেবসায়িক টার্গেট স্কুলের শিশুরা। এই গোলা আইসক্রিমের ওপর প্রতিদবেদন তৈরি করতে এটিএন নিউজের একটি টিম সাত দিনের কাজ করে সায়েন্স ল্যাবরেটরির সাহায্য নিয়ে বের করে এনেছে গোলা আইসক্রিমের মূল উপাদানগুলো কি কি এবং এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াসমূহ। যে বরফটা ব্যবহার করা হয় সেটি সম্পূর্ণ দুষিত এবং মাছ সংরক্ষণ করতে ব্যবহার করা হয়। যেই রঙ ব্যবহার করা হয় এগুলো ফুড কালার নয়। টেক্সটাইল মিলের রঙ বলে চিহ্নিত করেছেন সায়েন্স ল্যাবরেটরির অনুবিজ্ঞানীরা। যার প্রভাবে শিশুর কিডনি থেকে কলেরা, টাইফয়েডসহ নানা মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশী! এদের নেই কোন বৈধ লাইসেন্স ! অনুমতিহীনভাবে পুরো ঢাকা শহরে ছেয়ে গেছে বিষাক্ত গোলা আইসক্রিম!
আসলে কি তেমন কোন খাবার কিংবা পানীয় আমাদের দেশে আছে যা স্বাস্থ্যসম্মত? পানি প্রাকৃতিক উৎস থেকে আসা! সেখানে আর্সেনিকের ছোবল! সেই আর্সেনিকযুক্ত পানি দিয়ে যে সকল রান্না বান্না, চাষাবাদ করা হয় সব জায়গায়-ই আর্সেনিক ছড়িয়ে যায়। পানীয় হিসাবে তো আর্সেনিক সরাসরি আমাদের দেহে ঢুকে গিয়ে ধিরে ধিরে আমাদের শরীরের নানা রোগে আক্রান্ত করে ফেলে।
দুধ দিয়ে শুরু করেছিলাম ওখানেই ফেরত যাই! দুধে কতো রকমের ভেজাল তা সবার-ই জানা। শিশু খাদ্য দুধেও পাওয়া গেছে বিষাক্ত মেলামাইন। আর দুধে পানি মিশানো নতুন গল্প নয়। তবে যে সকল জায়গা থেকে পানি সংগ্রহ করা হয় সেটিও থাকে বিষাক্ত কল কারখানার বর্জ্যে আবৃত। ময়লা পানি ও ফরমালিনযুক্ত দুধ পান করে বর্তমানে দেশে অনেক শিশুই কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণে শিশুদের হাড়ের জোড়ায় দূরত্ব সষ্টি হয়ে পড়ছে। ফুলক্রিম মিল্ক পাউডার মেশানো দুধ পান করলে কিডনির নেফরোটক্সিসিটি ও লিভার হেপাটোটিক্সিমস দেশের গুরুতর ক্ষতি হতে পারে। শিশুদের শরীরে মরন ব্যাধি ক্যান্সার দেখা দিতে পারে। সরাসরি গরুর সামনে থেকে দুধ নিয়ে আসলে খাটি দুধ পাওয়া যাবে। এই পন্থাটি অনেকেই অবলম্বন করা শুরু করেছেন। কিন্তু গোয়ালা গাভীকে এমন কিছু ট্যাবলেট খাওয়ান যাতে গরুর দুধ বেশী পাওয়া যায়! সেটির একটি পরিমান থাকলেই বেশী আয়ের আশায় গোয়ালারা অতিরিক্ত হারে ঐ ট্যাবলেটটি খাইয়ে থাকেন !
প্যাকেটকৃত, প্রক্রিয়াজাত তরল ও কঠিন খাদ্যের অধিকাংশই বিষ ও ভেজালে ভরপুর। বাজারে প্রায় সমস্ত শাকসবজি, ফলমূল যেমন, টমেটো, পেঁপেঁ, কলা, আঙ্গুর, আপেল, কমলা ইত্যাদি ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত। ব্যবসায়ীরা কৃত্তিম উপায়ে ফল পাকাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড, কপার সালফেট, কার্বনের ধোঁয়া, পটাশের লিকুইড সলিউশনসহ বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক ব্যবহার করছে। ফলগুলোকে টাটকা ও তাজা রাখতে ফরমালিন ব্যবহার করা হচ্ছে।
২০১২ সালে দিনাজপুরে গাছের নীচে থেকে কুড়ানো লিচু খেয়ে ১৮ জন শিশু মারা গিয়েছিল! লিচু গাছে থাকা অবস্থায় কীটনাশক বিষ দেয়া হয়েছিল বলেই এই ঘটনাটি ঘটেছিল বলেছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট গবেষণা চালিয়ে নিশ্চিত করেছিল !
ফার্মের মুরগীর প্রধান যে খাদ্য সেটি তৈরি করা হয় মুলত হাড়ের গুরা থেকে। কিন্তু ট্যানারির পচা বর্জ্য মিলায়ে একটি চক্র মুরগীর খাবার বানিয়ে থাকে। যে খাবার মুরগি খেলে মুরগীর ডিম থেকে শুরু করে মুরগীর মাংসও বিষাক্ত হয়ে যায়। ফলে মানবদেহে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ছেই !
উপকূলীয় অঞ্চলে ঘেরে চাষ করা চিংড়ির খাবারে নিষিদ্ধ নাইট্রোফুরানসহ ক্ষতিকর এন্টিবায়টিকের উপস্থিতি পাওয়ার কারনে ২০০৯ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে বন্ধ হয়ে যায় চিংড়ি রপ্তানি। সে সময় সরকার ব্যবস্থা নেয়ার ৬ মাস পর আবার শুরু হয় রপ্তানি।
২০১২ সালের জানুরারি মাস  থেকে শুরু হয়েছে স্পন্দন তেলের যাত্রা ! ধানের কুড়া থেকে তৈরি করা হচ্ছে স্পন্দন তেল ! সম্পূর্ণ ভারতীয় প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি দিয়ে বেসিক ব্যাংকের অর্থায়নে শেরপুর জেলা এলাকায় কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই তেল প্রাকৃতিক ভিটামিন ও খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ এবং শতভাগ কোলেস্টেরলমুক্ত। এতে ভিটামিন এ, ডি, ই ও ওমেগা-৩ আছে, যা রক্তের এলডিএলের (মন্দ কোলেস্টেরল)মাত্রা কমিয়ে এবং এইচডিএলের (ভালো কোলেস্টেরল) মাত্রা বাড়িয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করে।
তবে এদের কোন বিজ্ঞাপনেই বিএসটিআই অনুমোদিত কিনা উল্লেখ করা চোখে পরে নাই! (আমি নিজেও একবার কিনেছি) অন্য সব দেশীয় তেল থেকে মূল্য অনেক বেশী এবং দেশের সুপার শপগুলাতে স্পন্দন বেশী চোখে পরে!
জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল পাওয়া গেছে। মাছে মেশানো হচ্ছে জীবন ধ্বংসকারী বিষাক্ত ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথেফেন, প্রোফাইল প্যারা টিটিনিয়াম (পিপিটি) পাউডারসহ নানা ক্ষতিকর উপাদান।
বিভিন্ন কোম্পানির উৎপাদিত প্যাকেটজাত খাদ্য যেমন ফলের রস, স্ন্যাকফুড, গ্রীনপী, জ্যাম-জেলী, আচার-চাটনীতে বিভিন্ন ধরণের ক্ষতিকর রং ব্যবহার করা হয়। রাসায়নিক বিষ মেশানো খাবার খেয়ে মানুষ দীর্ঘমেয়াদী নানা রকম রোগে বিশেষ করে শ্বাসকষ্ট, এ্যাজমা, গ্যাস্ট্রিক, লিভার নষ্ট হয়ে যাওয়া, ক্যান্সারসহ নানা রকম ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। গর্ভবতী মহিলারা জন্ম দিতে পারে বিকলাঙ্গ শিশু। দীর্ঘদিন ধরে এসব ভেজাল/বিষাক্ত খাবার গ্রহণের ফলে বয়স্কদের মধ্যে ক্যান্সার জাতীয় রোগের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে খুব বেশী।
ভেজাল বা বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে মানবদেহে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। শ্বাসকষ্ট, এ্যাজমা, গ্যাস্ট্রিক ও লিভার নষ্ট হয়ে যাওয়াসহ ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।
যেখানে ১৯০৬ সালে আমেরিকায় ফরমালিন নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেখানে ২০১৩ এসেও আমাদের মতো উন্নয়নশীল গরিব দেশে ফরমালিনের ব্যবহার তুঙ্গে!
দেশে সেই ১৯৫৬ সালে বালাই দমনের জন্য যে সামান্য বালাইনাশক দেয়া শুরু হয়েছিল (৭৪ সাল পর্যন্ত সরকার বিনামূল্যে বিতরণ করতো) এখন সেটি ক্রয়, বিক্রয় রোধ করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
নিরাপদ খাদ্য তৈরি, বিপণন, ও বিক্রয়জাতকরণের জন্য আমাদের দেশে কিছু আইন রয়েছে। পণ্য আইন ১৯৫৬, বিএসটিআই (সংশোধিত) আইন ২০০৩, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, বিশুদ্ধ খাদ্য (সংশোধিত ) আইন ২০০৫ আছে কিন্তু এর সঠিক প্রয়োগ নেই! বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪’-এর ২৫ (গ) ধারায় খাদ্যে ভেজালের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের  বিধান রাখা হয়েছে।
সরকারের ভেজাল বিরোধী অভিযান সত্বেও বিষাক্ত বা ভেজাল খাদ্যের রমরমা ব্যবসার উপর কোন প্রভাব পড়ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না।
দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে খাদ্য চাহিদা। খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে নীতি নির্ধারকদের ভাবনার অন্ত নেই। এখনো দেশের ২০ শতাংশ মানুষ দৈনিক ১৮০০ ক্যালরির কম পরিমাণে খাদ্য পায় আর সাত শতাংশ মানুষ মাত্র ১৬০০ ক্যালরি খাবার পায়। সব মিলিয়ে ৩৮ শতাংশ মানুষ আজ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। ছয় কোটি লোক অপুষ্টিতে ভুগছে।
শিশু কিশোরদের স্বাভাবিক দৈনিক বিকাশে গুণগত পুষ্টি মানসম্পন্ন খাবার সরবরাহ সহ নানা ধরনের জটিল ও কঠিন রোগ থেকে রক্ষা করি এবং বিষাক্ত ক্যামিকেল ও ভেজালমুক্ত খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করি। বিষমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকারকে খাদ্যে বিষ মিশ্রণের উৎসমূল থেকে শুরু করে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা কঠোর নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এ অবস্থায় তারা বিশুদ্ধ খাদ্য নিশ্চিত করতে খাদ্যে গুণগত মান নিয়ন্ত্রণে কমিশন গঠনের পাশাপাশি কমিশনের অনুমতি ব্যতীত খাদ্যের বিপণন এবং প্রচার নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন