বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৩

বাংলার নারী যুগে যুগে!

নারী: প্রথম গল্প – রুমি আমার নানু। বয়স ১০০ পার হয়ে গেছে। মাশাল্লাহ এখনও ভাল আছে। হেঁটে চলে খেতে পারেন। অষ্টম শ্রেণী পাশ। সেই সময়ের নারী অষ্টম শ্রেণী পাশ মানে বিশাল পড়াশুনা! তাও যদি হয় গ্রামের তৎকালীন রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। চার কন্যা এবং তিন পুত্র সন্তানের জননী। সবাই স্ব স্ব স্থানে ভালো আছেন। নানা ভাই মারা গেছেন প্রায় ১২/১৩ বছর আগেই। আমার নানা ভাই ছিলেন মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষক।
 নারী দ্বিতীয় এর গল্প – আমার আম্মা (নাম বললাম না)। জন্ম ১৯৪৮ সালে। আমার মায়ের ছাত্র জীবনের নানা গল্প আম্মা আমাদের সাথে নানা সময় নানা ভাবে শেয়ার করেছেন। আমার মায়েরও ৫ কন্যা ১ জন পুত্র। আব্বা মারা গেছেন ২০১০ সালে। আম্মা আব্বার অসাধারন প্রেমের গল্প এখন নাই বা বললাম। গ্রেজুয়শন শেষ করেছেন অনেক ঝুঁট ঝামেলার মধ্যে দিয়ে। তিনি বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী। বড় আপা নিয়ে গেছেন। মেঝো বোনটি ১৯৯৮ সালের মারা গেছেন ২৫ বছর বয়সে।
তিনি যখন স্কুলে যেতেন সেই সময়ে মেয়েরা খুব একটা স্কুলে যেত না। (নানুর শিক্ষা জীবনের গল্প আমি জানি না)। আম্মা ভালো মতই প্রাথমিক বিদ্যালয় পাশ করলেন। কিন্তু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে আমার স্কুল শিক্ষক নানা ভাই অমত করলেন। কিন্তু আমার মা অটল। আম্মা মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হলেন। ক্লাসে একজন নারী আর বাকিসব ছেলেরা! অদ্ভুত ব্যাপার হল আম্মাকে কখনোই তার ছেলে বন্ধুদের কাছ থেকে অস্বস্তিকর কিছু পেতে হয়নি। একজন ছিলেন যিনি আম্মাকে খুব পছন্দ করতেন। তাও কি তার বড় ভাইয়ের বউ বানাবেন বলে! বলতো “তুই রাজি হবি না মানে? “পালকি পাঠায়ে নিয়া যাবো ভাবি করে।
এসএসসি পাশের পর আম্মার বিয়ে হল। তাও অদ্ভুত! এখন স্কুল শিক্ষক আম্মাকে দেখে খুব ভালো লেগে গেল। তিনি তার চাচাতো ভাইকে বিয়ে করালেন। তারপর একে একে আমরা জন্ম হচ্চি আর আমার আম্মা পড়াশুনা চালিয়ে গেছেন! আব্বার দিক থেকে খুব সমর্থন স্বশরীরে না থাকলেও অমত করেন নি। (মানে আব্বা তেমন সাহায্য করেন নি)। আমার মেঝো বোনের জন্মের পর আম্মা এইসএসসি পরীক্ষা দিতে গেছে ওকে ৩ দিনের রেখে! ফেইল করেছেন কিন্তু হাল ছাড়েন নি। একদিন এভাবেই উনি পাশ করে গেলে বিএ। কিন্তু আমার আব্বা আম্মাকে চাকরী করতে দেন নি! আম্মা খুব মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। তাতে কি? তারপরও তিনি ভালো ছিলেন । এখনো খুব ভালো আছেন তবে মেঝো মেয়ে আর স্বামীকে হারিয়ে একটা অদ্ভুত জীবন উনার। এ ছাড়া তেমন কোনো সমস্যায় পরতে হয়নি।
এবার আমার পালা – তৃতীয় নারীর গল্প – সুধা! 
সুধা আসছে ব্যাস কেপে উঠত বাড়ির উঠোন। সকলে বুঝে যেতো আমার অবস্থান। গাব গাছের আগায় নাকি পেয়ারা গাছের ডগায়। পুকুরে জাল দিয়ে মাছ ধরতে নাকি জেলেদের পিছনের কাঁদা ছুরে খাওয়ার তোপে। ধান খেতে নাকি আলু তুলছে?
কুতকুত খেলা নয়! গোল্লাছুট, কাবাডি এগুলো হলে খেলতে রাজি। সেই আমি আজো সেই আমি। ডানপিটে! বাকপটু!
প্রাথমিক বিদ্যালয় ছেলে মেয়ে একসাথেই গ্রামে কাটিয়েছি। সুন্দর জীবন ছিল। দুরন্ত জীবন। ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হলাম সেখানেও ছেলে মেয়ে একসাথেই। (ক্লাস সিক্স এর সহপাঠী একজন ছেলে বন্ধু এখন আমার সন্তানের পিতা) শুরু করলাম প্রেমপত্র পাবার। সবার একটি চিঠি ! তুমি আমার জীবনের প্রথম প্রেম! সম্বোধন ও ইতি থাকতো নানা রকমের “ওগো আমার জান” ইতি তোমার প্রেমে দিওয়ানা!
আমি তো দুষ্টু ছিলাম। তাই কেউ চিঠি দিলেই বলতাম এইতা কয়হাত ঘুরে আমার কাছে আসছে? কিংবা আমি ফেরত দিলে কয়জনের কাছে যাবে? কারন আমি জানতাম ওদের মানসিকতা। যাক মাধ্যমিক জীবনটা সব মিলিয়ে কাটিয়ে ভর্তি হলাম কলেজে। আহ ফ্রেশ কি শান্তি! এক গুচ্ছ মেয়ে। দুষ্টের শিরোমণি সুধা। অসাধারন বছরগুলো কাটল !
কলেজ জীবন পাশ করে আমার আর পরাশুনা হয়নি। চাকরীতে ঢুকে গেলাম। অসাধারন পরিবেশে কাজ করলাম সাড়ে চার বছর। তারপর যোগদান করলাম আমাদের দেশের শীর্ষ স্থানীয় একটি লিমিটেড কোম্পানিতে। আহ কি অদ্ভুত! আমি যেই বিভাগে কাজ করি সেখানে একমাত্র নারী আমি! শুরুতে খুব ভালো ছিলাম। ঐ সহকর্মীগুলো খুব আন্তরিক ছিলেন। পরে এবং   বর্তমানে যেই বিভাগে কাজ করি সেখানেও আমি একা নারী। চারপাশে ৩০/৪০ জন পুরুষ সহকর্মী!
খুব ভালো ভাবে কাজ করছি সেটা বলতে পারছি না বলেই ১৯০০ সাল থেকে ২০১৩ সালের গল্প তিন নারীর তুলে ধরছি। নানা ভাবে অপদস্ত হয়েছি, হচ্ছি! তাই বলে আমিও দমে নেই! আমি সৎ, সাহসী, দায়িত্ব বান। তাই আমাকে কেউ বিভ্রান্ত করতেও পারে না সহজে। তবে এটাও সত্যি মাঝে মাঝে অসহায় লাগে, কান্না পায়! এই কোন যুগে এসে কিভাবে থাকতে হচ্ছে আমাকে। এরা কারা? দেশের সকল নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা! এদের মানসিকতা এত নোংরা এত ছোট কেন?
গতকাল ও মিটিং করলাম স্যারদের সাথে। আমার সাথে আচরণ আমার সহকর্মীদের বিষয়ক। অদ্ভুত! কিন্তু কেন? কেঁউ বলতে পারে কিন্তু কেউ পারে না। কারন আমাকে কেউ মেরে পার হয়ে যাবে আর আমি শুধুই কাঁদবো এমন নারী আমি নই। আমি প্রতিবাদী। প্রতিবাদ করেছি বলেই এখনো সুন্দর ভাবে টিকে আছি। ইনশাল্লাহ হয়তো থাকবো!
অতি সম্প্রতি আমার বিভাগীয় প্রধান আমাকে নানা ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করছেন যেন আমি চাকরি ছেড়ে দেই! আমার চাকরির দরকার নেই এটা উনি অনুভব করছেন। হাস্যকর! আমার স্বামী যেহেতু একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তাই আমি কেন চাকছি করছি! নানা ভাবে আমাকে বুঝাচ্ছেন। যেমন- গত বৃহস্পতিবার অফিস আসি নাই অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার স্বামী আমার বসকে জানিয়েছিলেন। গতকাল বড় স্যার ডেকে নিয়ে বললেন সুধা (অফিসিয়াল নাম বললাম না) তোমার সেদিনের বেতন কাটা! অথচ আমি একজন যে অতি দায়িত্বশীল, কর্মদক্ষতা অনেক ভালো। গর্ব করার সাহস পাই এই কারনে আমি যেই কাজ করি সেই কাজের অনেকেই আছেন। কিন্তু আমার একান্ত নিজস্ব পরিকল্পনায় করা দুইটি কাজের ফলাফল এত ভালো যে আমাদের কোম্পানি ওটার উপর ভর করেই আছে গত চার বছর। (কোম্পানিটি সকলের চেনা জানা এবং এখন সবার মুখে মুখে কুৎসাও কোম্পানি গুণগত মান নিয়ে রটছে তাই নামে বললাম না)।
সকলেই হাস্যকর! তবে সুধা এত সহজে হেরে যাবার নয়।
‘অন্যায় যে করে আর যে সহে দুজনেই সমান অপরাধী’। আমি কোনো অপরাধকে প্রশ্রয় দিতে এক বিন্দুও রাজি নই! প্রতিবাদ করতে কার্পণ্য করলে হবে না। সৎ থাকলে সকল প্রতিকুল অবস্থা মোকাবেলা করে পরিবর্তন আনতে হবেই হবে।
তারপর একদিন হুট করে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম গ্রেজুয়েশন শেষ করতে। হায় খোদা! ক্লাসে ৩৫/৩৯ টা ছেলে আর আমি একটি মাত্র মেয়ে! তবে এই সহপাঠীরা এক কথায় অসাধারন। নানা বয়সের, নানা পরিবারের, নানা ক্লাসের তারপরও ওদের তুলনা ওরাই! এই ছেলেগুলোর সঙ্গে কাঁটিয়ে দিলাম চারটি বছর! (গল্প সংক্ষেপে ইতি টানলাম)..।
বর্তমান অবস্থায় কোথায় সকলের মন মানসিকতার উন্নতি হবে? কিন্তু অবনতি লক্ষণীয়! কেউ বলে কেউ বলে না। কেউ স্বীকার করে কেউ করে না। একজন নারী বলতে পারবে তার আসল বাধা সমূহ। যতই নিজেকে নারীর আসনে বসিয়ে একজন পুরুষ ভাবে না কেন। কিছুই বুঝবে না! একজন নারীর বলাটা বুঝাটা উপলব্ধি করাটা অনেক অংশেই আলাদা ও অভিন্ন!
রাস্তা ঘাটে চলাচল, কেনাকাটা করতে যাওয়া, বেড়াতে যাওয়া- সর্বত্র একটা বাধা আসবেই। নানা রঙ্গে নানা ঢঙে! আমার মা বলে আমাদের সময়টায়-ই অনেক ভালো ছিল। আমিও তাই দেখছি। আম্মা অনেক সাবলীল জীবন যাপন করেছে স্কুল কলেজ জীবনে। বরং উল্টোটি হতে পারতো। কিন্তু হয়নি!
এই যুগে কর্মক্ষেত্রে আজো একা নারী? বিশ্ববিদ্যালয়ে একা নারী? যখন ক্যালেন্ডার খুললে দেখি ২০১৩ সাল! আমরা এ যুগের মেয়েরা কি পিছিয়ে নাকি ওদের সাহস নেই। আমার ছোট বোন বলে সুধা আপা আমাদের ক্লাসের মেয়েদের একটাই লক্ষ্য চাকরি নয়! কেবল বিশ্ববিদ্যালয় পাশ। তারপর বিয়ে! যেখানে আমার নানু ১৯০০ সালের দিকের নারী আমার আম্মা এবং আমিও লড়েছি! তারপরও কেন এত প্রতিবন্ধকতা?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন