বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৩

চলতি পথে হঠাৎ থামিলাম! (বিড়ম্বনা-১)

টানা নয় দিন ছুটিতে ছিলাম অসুস্থতা জনিত কারনে। সম্পূর্ণ গৃহবন্দী এবং বিছানার উপর শুয়ে থাকা টি ভি রিমোট হাতে নেয়া একজন গৃহবধুর জীবন। ৯ দিনের বাংলাদেশী টি ভি চ্যানেল আর ভারতীয় বাংলা চ্যানেলসহ বাকি সব চ্যানেলের একজন টানা দর্শক হিসাবে যা যা দেখলাম:
আমাদের দেশে বাংলা টি ভি চ্যানেল আছে প্রায় ২৫ এর অধিক! এর মধ্যে কেবল  খবরের চ্যানেল আছে ৫ এর অধিক! যারা দিনব্যাপী খবর, খবরের পিছনের খবর আবার কেউ কেউ মাঝে মাঝে রান্না অনুষ্ঠান, টক ঝাল শো-ও  প্রদর্শন করে থাকে। ওই সকল চ্যানেলের খবর এর বাইরে বাড়তি বিনোদন হল তারকা কথন, তারকা খবর, সংস্কৃতি খবর, দেশে বিদেশে চলচিত্রের খবর। আরও আছে -
গ্রাম গঞ্জের খবর
বিকেলের সংবাদ
সন্ধ্যার সংবাদ
দুপুরের সংবাদ
মধ্য রাতের সংবাদ
সকালের সংবাদ
খেলাধুলার সংবাদ
অনেকে আবার ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কোথায় কি হচ্ছে এই খবরও প্রচার করে
রাতের সংবাদ
ইত্যাদি নামে খবর প্রচার করে থাকেন!
এবার আসা যাক বিনোদন চ্যানেলগুলুর দিকে। যেগুলুর মধ্যে চ্যানেল নাইন, এশিয়ান টিভি ছাড়া  অন্য চ্যানেলগুলু  মোটামুটি সকলেই প্রতি ঘণ্টায় সংবাদ প্রচার করে থাকে! সকল টিভি স্ক্রিনের নীচে স্ক্রলে সারাদিন তো  নিউজ টাইটেল চলতেই থাকে অনবরত!
একটু পর পর আসে ব্রেকিং নিউজ! তবে ব্রেকিং নিউজগুলু এখন দর্শকদের খুব একটি মন ব্রেক করতে পারেনা। কারন বা অকারনেই কিছু মানহীন নিউজ ব্রেক করে দেয়।
আমাদের দর্শক আটকাতে ইদানিং যেসব নাটক বানানো হচ্ছে সেগুলু এমন পর্যায়ে যে, নাটকগুলু ভারতীয় নাটকীয়তাকেও হার মানায়! যারা স্টার, জলসা কিংবা জি বাংলা ঋণাত্মক সমালোচনায় মগ্ন তারা যদি নিমা রহমান, শম্পা রেজা, দিতি, চম্পা, ইলিয়াস কাঞ্চন  প্রমুখ অভিনেতা অভিনেত্রীদের অভিনীত নাটকের গল্পের মান, পাত্র পাত্রীদের সাজগোঁজ, এবং নাটক তৈরির মান নিয়ে লজ্জা পাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই!
ওপার বাংলার মানে ভারতীয় টি ভি চ্যানেলগুলুর- রাশি, সাত পাঁকে বাধা, মা, জল নুপুর, ইষ্টি কুটুম ইত্যাদি নাটক তৈরির মান, গল্পের ধরন, পাত্র পাত্রীদের সাজগোজ ইত্যাদি তাদের সংস্কৃতির সাথে যায়। কারন তাদের যৌথ পরিবার রীতি এবং মেয়েরা আজও সমাজে অনেকটা মাথা নিচু করে চলতে হয় এবং এদের নাটকের প্লাসটিসিটি, ইলাস্টিসিটি নিয়ে কথা না বলাই ভালো! ওদের নাটক শেষ হয়ে আবার শুরু হয়! তবে উক্ত চ্যানেলগুলু দেখতে ভালো লাগার কারন হিসাবে আমি চিহ্নিত করেছি কয়েকটি কারন ! যার মধ্যে অন্যতম গুলু হল –
-কম বিজ্ঞাপন
-বিজ্ঞাপন বিরতিটাও খুব কম
-একটি অনুষ্ঠান শেষ হতে না হতেই পরবর্তী অনুষ্ঠান শুরু করে দেয়া
-বিনোদন চ্যানেল কেবল বিনোদন আছে। খবর, টক শো জাতীয় কিছুই নেই
-ব্রেকিং নিউজ নামক নিউজ টাইটেলও নেই
এবার যদি হিন্দি চ্যানেলে যাই তাহলে বলবো আমি যেহেতু হিন্দি ভাষা বুঝিনা তাই ঐ সকল চ্যানেলে কেবল গান বাজনা ছাড়া মাঝে মাঝে দু একটি সিনেমা দেখে হা হা হু হু করি!
দেশে ফিরে আসি আবার। আমাদের মাতৃভুমি বাংলাদেশ। সোনার বাংলার বেসরকারি টি ভি চ্যানেলগুলু নিয়া একটু আলোকপাত করি!
এনটিভিতে দেখলাম ”নাভিদ মাহমুদ শো” সুন্দর সাবলীল অনুষ্ঠান। বিজ্ঞাপন ঝামেলা নেই। গ্রামীন ফোন স্পন্সার করেছে। খুব সাধারন গল্পের ছলে হাসির অনুষ্ঠান। তবে সপ্তাহে এক দিন। তাই ক্যালেন্ডার এ দাগ কেটে রাখতে হবে!
দেশ টিভিতে –”দেশ-ই গল্প” ! খুব সুন্দর। আলি যাকের, সারা যাকের দম্পতির একমাত্র সু-পুত্র ইরেশ যাকেরের সঞ্চালনায় অসাধারন হাসির গল্পের অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানটিও মাত্র সপ্তাহে একদিন। তাই ক্যালেন্ডারে দাগ কেটে রাখতে হবে!
চ্যানেল আইতে স্পেলিং বী, এন টিভিতে ক্লোজ আপ অয়ান, চ্যানেল নাইন পাওয়ার ভয়েসও দেখার মতো অনুষ্ঠান ।
আপনি যদি শুধু বিনোদন প্রিয় একজন মানুষ হন তবে আপনাকে হয় একজন পিএস কিংবা একটি ডায়রি সাথে রাখতে হবে ! যেখানে তারিখ, বার, ঘড়ির সময় লিখে রেখে মাঝে মাঝে অনুষ্ঠান দেখতে হবে টিভিতে!

ইদানিং শুরু হয়েছে মধ্যরাতে থেকে শেষ রাত পর্যন্ত লাইভ গানের অনুষ্ঠান। ও রে বাবা দেখলাম রাত তিন টা বেজে গেল গায়ক, গায়িকা, উপস্থাপিকা যেন আর চাঙ্গা হয়ে উঠলেন! তবে যেহেতু আমি গান পাগল মানুষ এবং অসুস্থ ছিলাম পাশাপাশি ঘুম ছিলো না একা একা জেগে ছিলাম তাই আমার সঙ্গী হিসাবে খুব খারাপ ছিল না। সম্ভবত আমার মতো অসুস্থ মানুষদের জন্যই ঐ অনুষ্ঠানগুলু তৈরি করা হয়!
আর যদি টক শো, রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে পর্যালোচনামূলক অনুষ্ঠান দেখতে আগ্রহী হন তবে “নাকে তেল দিয়ে ঘুমান “ ! থুক্ক নিশ্চিত মনে টিভি খুলে বসুন। সারাদিনের কাজ শেষে বাসায় ফিরে দেখেব সবাই আপনার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে! কেউ কেউ আপনাকে সরাসরি ফোন প্রশ্ন করার সুযোগও করে দিবে!
দৈনিক টি ভি অনুষ্ঠানসুচি আংশিক এমন সব নাটকে (!) -
আর টি ভি  – বয়রা পরিবার, অলসপুর নামক মেগা নাটকগুলু সুন্দর! কিন্তু বিজ্ঞাপন ভিড়ে হারিয়ে যায় কখন কোথায় ছিলাম।
বাংলাভিশন – বিজ্ঞাপন বিরতি কম!
এটিএন বাংলা – সংসার সুখের হয় বেদনার গুনে, কবুলিয়তনামা, টো টো কোম্পানির ম্যানেজার, উত্তরাধিকার
জিটিভি – ক্রাইম ফ্রিকশন, জননী,
এশিয়ান টিভি  – জীবন সংসার, সেকেন্ড ইনিংস
বৈশাখী টিভি – অগ্নিপথ, বড় বাড়ির ছোট বউ
চ্যানেল আই – রোশনি
একুশে টিভি – সুখে থাকলে ভুতে কিলায়, চার কন্যা
মাছরাঙ্গা – ক্ষণিকালয়, ইউনিভারসিটি
যেই নাটকগুলু দেখলে যেকোনো দর্শক হয় টিভি ফেলে দিবেন  না হয় টিভি দেখবেন না কিংবা ভারতীয় চ্যানেলে ঝুঁকতে বাধ্য। দিন শেষে বিনোদন তোঁ চাই সেটা চার দেয়ালে বন্দী জীবনে থেকেই হোক। মন্দ কি! কিন্তু এই মন্দের দ্বন্দে পুরো দেশ কাঁপছে আর দুষছে নারীদের যে তারা নাকি বিকৃত মস্তিস্ক হয়ে গেছে! তবে আমাদের দেশের বড় বড় খ্যাতিমান পুরুষ নাট্যকার, নির্মাতারা কি করছেন? আমাদের নারী নির্মাতা সংখ্যা তোঁ মাত্র ৩/৪ জন!
ভারতীয় টিভি বন্ধ করে নয় অদের সাথে রেখে অনুষ্ঠান বানানো হোক! প্রহসন বন্ধ করে সংস্কৃতি মনা হন দর্শক দেখবেই। হাঁসের মতো গিলবে! “ মিরাক্কেল” কিভাবে আমরা উপভগ করি? “ হা শো “ কিংবা ” তারকা কমেডি ” কেন সেই আদলে তৈরি করতে গিয়ে ভারতে আবু হেনা রনি, সজল, ইশতিয়াক নাসের তৈরি হচ্ছে! যারা আমাদের দেশের-ই ছেলে!
সেদিন ” মিরাক্কেল ” দেখলাম সঞ্চালক মীর গর্ব করে বলছেন ” উনারাই প্রথম আমাদের দেশের খ্যাতনামা সঙ্গিত শিল্পী রুনা লায়লার সুপ্ত প্রতিভা নাচ প্রদর্শন করাতে পারলেন চেয়ারে বসে হলেও ” ! কেন আমরা আমাদের নির্মাতারা পারছেন না?
এবং এই মিরাক্কেল এর স্পন্সর করেছেন আমাদের দেশের ” প্রাণ গ্রুপ “ ! দোষ দর্শকদের নয়! নির্মাতা, টিভি কর্তৃপক্ষ এবং স্পন্সরদের।
এর মধ্যে এশিয়ান টিভি এবং চ্যানেল নাইন আসলে কোনদেশর টিভি চ্যানেল বুঝা মুশকিল! সাথে যোগ দিয়েছে চ্যানেল আই রোশনি প্রচার করে! আবার অনেকে তো নিজের জন্য একটি টিভি চ্যানেল খুলে বসে আছেন! যার চ্যানেল নিজের এলাকার খবর, নিজের খবর ছাড়া কিছুই দেখা যায় না! আমরা বাসায় উক্ত চ্যানেলটিকে ঐ রাজনীতিবিদের মাইক বলে থাকি! একটি নয় একাধিক টি ভি চ্যানেলের-ই এই বেহাল দশা!
দীর্ঘ নয় দিনে আমি বিরক্ত বাংলাদেশী চ্যানেলগুলুর প্রতি! রিমোটের ১ – ২৫ পর্যন্ত বাংলা চ্যানেল! একটি গানের চ্যানেলও আছে! কিন্তু মেজাজ তিরিক্ষি করতে অগ্নিপথ কিংবা জননী যথেষ্ট!
৩০ মিনিট নাটকের আসল সাইজ কত মিনিট এই তথ্যটি  স্বয়ং নাটক নির্মাতাও জানেন না! পরশু রাতে একটি নাটক দেখছিলাম চয়নিকা চৌধুরীর নির্মাণে। কি হল নাটকের মাঝেই শেষ! কারন ঘড়ির কাটা ঘুরে গেছে। সময় হয়ে গেছে খবরের। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আহা কি প্রেমের নাটকটাই না ছিল! শেষটা দেখা হল না…।
যে সব নারীরা বাসায় থাকেন, সংসার সামলান তারা কাজের ফাঁকে বিনোদন বলতে হয় বাচ্চার স্কুলের গেইটে গল্প, কেনাকাটা (তাও ব্যাগে টাকা থাকলে)! বেশীরভাগ নারী বেছে নেন টিভি অনুষ্ঠান। নিঃসন্দেহে বলা যায় তারাও খুব ব্যস্ত জীবন কাটান! তাই তাদের জন্য মোক্ষম বিনোদন ভারতীয় বাংলা চ্যানেল! কারন অনুষ্ঠান শুরু এবং শেষ হবে ঘড়ির কাটা অনুযায়ী! প্রতিদিন নাটকের রুটিন লিখে রাখার দরকার নেই! বিজ্ঞাপনের ভিড়ে অনুষ্ঠান হারিয়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ভয় কিংবা শঙ্কা নেই!
একটি সময় ছিল যখন যখন শিল্পীরা শতভাগ পেশা হিসাবে অভিনয়কে গ্রহন করত না। কয়েকজন প্রথিতযশা নাট্যকার নাটক লিখতেন। কিন্তু এখন টিভি চ্যানেল, নাট্যকার, নাটকের সংখ্যা বেড়েছে। ফলে কাজের পরিমানও বেড়ে গেছে। এতে করে সব ক্ষেত্রেই ফোকাসের মাত্রাটা কমে গেছে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই আগের সাথে অনেক পার্থক্য এসেছে এখন। এটাকে পজিটিভ ভাবে নিয়ে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। কারন প্রতিযোগিতার জায়গা তৈরি হলে অনুষ্ঠান নির্মাণের কাজের মানও বাড়ে। অনেক ভালো কাজও হচ্ছে! তারপর ও -
আমাদের নাটক, টিভি অনুষ্ঠান বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দর্শকদের নজর কাড়তে পারছেনা কেন? এর উত্তর মূল কারন ‘বিজ্ঞাপন বিড়ম্বনা’। যে কোনো অনুষ্ঠান প্রচারকালে বিজ্ঞাপনের ভারে অনুষ্ঠানটি জর্জরিত হয়ে পরে। এতে অনুষ্ঠানটির প্রতি দর্শক নষ্ট হয়। কারন ধৈর্যচ্যুতির ফলে বিরক্তিতে ভোগে! টিভি চ্যানেলগুলু এ ক্ষেত্রে সচেতন হলে অবস্থার পরিবর্তন হবে!
সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা করি সকলে! দর্শক ঘরমুখো হবে! আমি মাত্র নয় দিনে তিক্ত বিরক্ত! উফ কি জঘন্য সব নাটক!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন