বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৩

অটিস্টিক নির্ঝর আর সেরেব্রাল পালসির সাকিন এরা আমাদের ই সন্তান ।

২ রা এপ্রিল অটিস্টিক দিবস !!
সাকিন
নির্ঝর
এই দুইজন ছেলেকে আমি খুব ভাল করে জানি এবং চিনি। একজন আমার পরিবারের সদস্য অন্যজন আমাদের এক বর ভাইয়ের ছেলে। কাকতালীয় ভাবে দুইজনের বয়স প্রায় একই বলা যায়।
০১. সাকিন আমার ভাসুরের (স্বামীর বর ভাই) একমাত্র ছেলে। সাকিন বয়স এখন ১২+ বছর। শেষ কবে ঘর থেকে বের হয়েছে আমার ঠিক মনে পরছেনা ! সাকিন সব সময় চার দেয়ালে বন্দী । জন্মের শুরুতে নানা চেষ্টা করলেও গত ১০ বছর যাবত আমি দেখছিনা সাকিনকে নিয়ে কেও ভাবছে ! সবাই নিজেকে নিয়ে আছে । ভাই ভাবী ভিতরের চিন্তা ভাবনা মাঝে মাঝে আমার জানার খুব ইচ্ছা হয় কিন্তু সাহস পাইনা কারন অনেক বার জানতে অজানা থেকেই ফিরে আসতে হয়েছে আমাকে। সাকিন এর কি হবে ?? সে বড় হচ্ছে একদিন আসবে যেদিন ভাই ভাবী নাও থাকতে পারে তখন ?
০২. নির্ঝর আমাদের এক বর ভাইয়ের ছেলে। বয়স ১০+ বছর। নির্ঝর-এর অটিজম ধরা পরার পর থেকেই ভাইয়া এবং ভাবি সাথে তাদের পরিবার একটা ভয়ানক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন । নির্ঝরকে নিয়া ওনারা কি না করছেন ? যুদ্ধ করতে করতে গত ৫ বছর যাবত নির্ঝর বাস করছে AUSTRALIA MELBOUNRE এ। আপা এবং ভাইয়ার মতে নির্ঝরের জীবন ওখানেই অনেক ভাল। ও একটা স্কুল পড়াশুনা করে। যেই স্কুলে নির্ঝর পড়ে তার সহপাঠীরা বেশির ভাগই স্বাভাবিক শিশু । ওখানে ওকে আলাদা কোন স্কুল পরতে হয়না। হ্যাঁ এটা সত্যি ওর প্রতি আলাদা যত্ন করে সবাই। গত ৫ বছরে নির্ঝর অনেক উন্নতি করেছে মানসিক বিকাশে । যদিও আপা ভাইয়া অনেক কষ্ট করে ভিসা পেয়েছেন। কারন অটিজম আক্রান্ত বিদেশী বাচ্চাদের ভিসা দিতে চায়না। কিন্তু আপা এবং ভাইয়া দমে জান নি । আপা থাকেন MELBOURNE আর ভাইয়া থাকেন ঢাকা শুধু নির্ঝর এর জন্য ওই জীবনে আছেন উনারা গত ৩ টি বছর। নির্ঝর আজ দৌঁড়ায়, খেলে আর সব স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতই বলা যায় । কেবল কথা বলেনা কিন্তু সব বুঝাতে সক্ষম। আপা ভাইয়া যুদ্ধে অনেকটা এগিয়ে গেছেন । শুধু সম্ভব হয়েছে একটা উন্নত দেশে নির্ঝরকে রাখতে পেরেছেন বলে।
নির্ঝর আর সাকিন এর মধ্যে অনেক তফাৎ । নির্ঝরকে নিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন ওর বাবা মা পুরো পরিবার। আর সাকিনকে সবাই মুখে মুখে আহা ! রে আহা ! রে করে। তবে কি সাকিন বাইরের আলো দেখতে পাবেনা ??
(আমি যখন সন্তানসম্ভবা তখন আমার এক খালা বলেছিলেন শুনো মা তুমি সাকিনের কথা বেশি ভেবো না। ওর দিকে বেশি তাকাইও না। কাছে যেও না । কারন সাকিন CEREBRAL PALSY তে আক্রান্ত)
( নির্ঝর এর মা বাবা অনেক অনুষ্ঠানেই উপস্থিত হতে পারেন নাই কারন নিষেধাজ্ঞা ছিল নির্ঝরকে আনা যাবে না। ওকে দেখলেই সব বাচ্চাদের সরিয়ে নেয়া হল পাগল বলে )
কেউ কি কখন দেখেছে নির্ঝর , সাকিন দের মায়েদের কান্না ? কেউ কি বুঝতে চেয়েছে এই বাচ্চাটির জন্য বাবা মা কেউ ই দায়ী নয় । তবু ও তারা সমাজ বঞ্চিত । কেন ?? আমরা সাধারনরা কেন এত অজ্ঞ ? আমি দেখেছি সাকিন-এর মায়ের কাঁন্না হাহাকার, আমি দেখেছি নির্ঝর এর মায়ের কাঁন্না, যুদ্ধ আর চিৎকার । আমিও একজন মা তাই আমি বুঝি আমার সন্তানটি যেমনি হক সেই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ। বড় আদরের।
২১ শে মার্চ ২০১২ এর এই দিনটাকে একটু শেয়ার করি। সেদিন ছিল নির্ঝর এর জন্মদিন। যেহেতু ও দেশের বাইরে থাকে তাই ২০ মার্চ রাতের বেলায় আমি WISH করেছি FACEBOOK এর মাধ্যমে।
সকালে যখন অফিস আসার উদ্দেশে বাসে উঠলাম, আমার পাশে বসা একজন ভদ্র মহিলা আমার সাথে কথা বলতে বলতে বললেন যে উনারও একজন AUTISTIC ছেলে আছে যাকে নিয়ে উনি যুদ্ধ করে যাচ্ছেন গত নয়’টি বছর। ছেলেটার নাম আমার মনে নাই। যাক, ওই ভদ্রমহিলা জয়ী হয়েছেন। তার ছেলে এখন অনেক স্বাভাবিক। ঢাকা শিশু হাসপাতালের শিশু বিকাশ কেন্দ্রে উনি ছেলের থেরাপি দিয়েছেন।
সন্ধ্যে বেলা যখন অফিস থেকে বের হব ঠিক তার আগ মূহুর্তে জানতে পারলাম আমার একজন সহকর্মীর ছেলের বয়স ৩.৫ বছর। তারও অটিজম ধরা পড়েছে এবং ডক্টর তাকে বিশেষ স্কুলে ভর্তি করতে বলেছেন সাথে শিশু হাসপাতালের শিশু বিকাশ কেন্দ্রে নিয়ে যেতে বলেছেন।
মনটা ভেঙ্গে গেল ! একদিনে ৩ টি বাচ্চার জীবন সম্পর্কে জানলাম ! এত অটিজম আক্রান্ত বাচ্চা চারপাশে কেন? এর থেকে কি প্রতিকার পাবার আগাম কোন সতর্কতা আছে সন্তান কাঙ্খিত বাবা মা’দের ? বিজ্ঞান কত দিক দিয়ে এগিয়ে গেছে কিন্তু তারপরও কেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই অংশগুলো আজ নড়বরে ? দুর্বল ?
২রা এপ্রিল অটিজম ও প্রতিবন্ধী দিবস। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তাদের কর্মক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ দিতে। আমার প্রশ্ন হল আগেতো আমাদেরই বাচ্চাগুলোকে কর্মক্ষম করে তুলতে হবে যার যার শারীরিক বিকাশ অনুযায়ী ।তারপর আসবে তাদের কর্মক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগের কথা। বিশেষ করে AUTISTIC. CEREBRAL PALSY আক্রান্ত বাচ্চদের বেলায়। কয়টা ভাল মানের শিক্ষালয় আছে? চিকিৎসালয় আছে? কয়জন ডাক্তার এর বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ?
একজন নির্ঝর অনেকটা এগিয়ে গেল বাবা মায়ের দূরদর্শী মনোবল এর জন্য । একজন সাকিন আজ চার দেয়ালে গৃহবন্দী। সাকিনদের বাবা মায়েদেরকে এগিয়ে আসতে ওদেরকে ঘর থেকে মুক্ত বাতাসে খোলা আকাশ দেখাতে কে অনুপ্রেরনা দিবে ?
অটিস্টিক অটিজম সম্পর্কে সবাইকে জানাতে হবে জানতে হবে। সজাগ থাকতে হবে। একটি শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ সম্পর্কে সবার সচেতন থাকতে হবে। এই ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি আমাদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে । অটিজম অটিস্টিক বাচ্চাদের সংস্পর্শে গেলে কোন ক্ষতি নেই এরা আমাদেরই সন্তান। এরা আমার আপনার মতই একজন মানুষ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন