বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৩

ভবন তৈরি: একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বলছেন!

ভবন নির্মাণে কি কি রহস্যময় অদ্ভুত কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে আশা করি সেটা পরিষ্কার হবে সকলের কাছে:
একটা বিল্ডিং ডিজাইনে যে পরিমাণ ফ্যাক্টর অফ সেফটি ধরা হয়, তাতে তা কলাপ্স করার সম্ভাবনাই থাকে না। কিন্তু তারপরেও এতো বিল্ডিং কেন ধসে পড়ছে? আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে এর একটা এনালাইসিস।
এবার আসুন দেখি ফ্যাক্টর অফ সেফটিগুলো কিভাবে আসছে—–
১) সয়েল টেস্ট রিপোর্টের মাটির বিয়ারিং ক্যাপাসিটিতে ২-৩ পর্যন্ত ফ্যাক্টর অফ সেফটি ধরা থাকে।
২) লোড কম্বিনেশনে ডেড লোড আর লাইভ লোডে যথাক্রমে ১.২ ও ১.৬ ফ্যাক্টর অফ সেফটি ধরা থাকে।
৩) ঝড় তুফান আর ভূমিকম্পের সাথে সর্বোচ্চ লাইভ লোড পাবার সম্ভাবনাও খুবই কম, তাই লোড কম্বিনেশনেও একটা সুবিধা পাওয়া যায়।
৪) মোমেন্ট হিসাবেও একটা ফ্যাক্টর অফ সেফটি ধরা থাকে।
৫) ভালো ডিজাইনাররা ডিজাইনে ঢালাইয়ের স্ট্রেন্থ ২৫০০ পিএসআই ধরলেও বাস্তবে ৩০০০ পিএসআই কনক্রিট স্ট্রেন্থের সাজেস্ট করেন।
৬) অনেক ডিজাইনার আবার কলাম/বিম ডিজাইনে যা রড আসে তার চেয়ে একটা বা দুটা রড বেশি দেন।
তাহলে বলেন, বিল্ডিং কেন ধসে?
এখন আসেন দেখি, পাবলিকের পইতালি কিভাবে একটা বিল্ডিং ডিজাইনকে দুর্বল করে——–
১)মালিকের পইতালি—
যদি ডিজাইনে পাইল দেন, তাহলে হুদাই ঘ্যানর ঘ্যানর করবে এই বলে, “ ভাই পাইলটা কি কুনো ভাবেই বাদ দেয়া যায় না?” আপনে যদি “না” করেন তাহলে জমির মালিক অতি জ্ঞানী হইলে আপনারে এভয়েড করে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার দিয়া থাম্ব রুলে পাইল বাদ দিয়ে বিল্ডিং বানাবে।
আপনি বিল্ডিং এর বিম/কলামে যে রড যে কয়টা দিতে বলবেন, সে পাশের বাড়ির কলামের রডের সাথে তুলনা করে তার চেয়ে কম রড দিবে। আর সাথে তো তত্ত্বাবধায়ক উপদেষ্টা মি রাজমিস্ত্রি ওরফে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার তো আছেই।
মালিক আর রাজমিস্ত্রির এহেন মাদবুরি উপরের বর্ণিত ১,২,৩,৪ আর ৬ নং ফ্যাক্টর অফ সেফটিকে দুর্বল করে ফেলবে।
সাধারণত সিমেন্টের গুনাগুণ সর্বোচ্চ দুই মাস পর্যন্ত মোটামোটি ভালো থাকতে পারে, যদি আপনে তা ভালো করে সংরক্ষণ করতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশ সময়ে ডেম সিমেন্ট দিয়েই অনেকে ঢালাই করে। এটা ৫ নং ফ্যাক্টর অফ সেফটিকে দুর্বল করে ফেলবে।
২) মিঃ রাজমিস্ত্রি ওরফে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের পইতালি-
এদের টলটলা ঢালাই মসলা না হলে মন ভরে না, তাই ঢালাইয়ের বন্ধু কাম শত্রু অতিরিক্ত পানি দিয়ে মসলা মিশাবে যা ৫ নং ফ্যাক্টর অফ সেফটিকে দুর্বল করে ফেলবে।
ডিজাইনারের অবর্তমানে অতি আগ্রহে জমির মালিকের টাকা সেইভ করার জন্য বিভিন্ন সময় রডের ডিজাইন চেঞ্জ করবে এবং সিমেন্ট কম দিবে। কিন্তু ঢালাইয়ের মালটা ভালো করে মিশাবে না কিংবা কাস্টিং করার সময় ভালো করে কম্পেক্ট করবে না। এতে করে ফ্যাক্টর অফ সেফটিগুলো আবার দুর্বল হবে।
আবার আপনি ডিজাইন করাবেন কমার্শিয়াল বিল্ডিং কিন্তু সেখানে ভাড়া দিবেন ফ্যাক্টরি, কিংবা ডিজাইনারকে বলবেন ৬ তালা করবেন কিন্তু বাস্তবে করবেন ৯ তালা, সেক্ষেত্রে আপনার অতি মুনাফা লোভ সবগুলা ফ্যাক্টর অফ সেফটিগুলো খেয়ে ফেলবে।
সুতরাং বুঝতেই পারতাছেন আপনাদের ওস্তাদি প্রতি ধাপে ধাপে কিভাবে ফ্যাক্টর অফ সেফটিগুলো খেয়ে ফেলে।
যার কাজ তাকে করতে দিন এবং দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে বিল্ডিং বানান।
ভবন কোড / আইন মেনে চলুন
তারপর তো আছেই ভবন নির্মাণের পর নতুন নাটক! আবাসিককে বাণিজ্যিক! আবার অনেক ক্ষেত্রে বাণিজ্যিককে বাণিজ্যিক কাজে ব্যাবহার করলেও আদৌই উপযুক্ত কিনা উক্ত বাণিজ্যিক কাজের জন্য সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে!
একটি উদাহরন দেই! তেজগাঁও এ একটি বাণিজ্যিক ভবনের একটি ফ্লোর আমাদের কোম্পানি ভাড়া নিয়েছিল গুদাম ঘর হিসেবে! এবং আমার পণ্য মজুদ করা শুরু করেছিল! কিন্তু একটি সময় দেখা গেছে প্রতি স্কোয়ার ফুট এ যতটুকু ভার বহন করার ক্ষমতা বলা হয়েছিল মালিক পক্ষ থেকে সেটি রক্ষা করতে উক্ত ভবনের ফ্লোরটি পারেনি! ফলে বিরাট আকারের ফাটল ধরেছিল। তারপর আমরা আমাদের পণ্য সরিয়ে ফেলে মালিক পক্ষের সাথে করা চুক্তি বাতিল করে দেই।
আমি যে ভবনটিতে বসে কাজ করি এটি আমাদের কোম্পানির নিজস্ব ভবন। সব কিছুই ঠিক ঠাক আছে। ভূমিকম্প রেকটার স্কেল এর ৭ হলেও নাকি ভাংবেনা। কিন্তু অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা খুব-ই নাজুক। আমি যে সেকশন কাজ করি সকলেই উদ্ভিগ্ন আগুন লাগলে কি হবে! আমি যে ভবনটিতে বাস করি ওটার অবস্থা তো আরও বীভৎস! কারন মোহাম্মদপুর মানেই হল পাশাপাশি কোন ফাঁকা থাকেনা! আমার বাসা কেন? ঢাকা শহরের বেশিরভাগ ভবনগুলোর এ বেহাল দশা।
আবাসিক ভবন গুলোতে তো অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা আরও নাজুক। নেই বললেই চলে। এই দিকগুলো বিবেচনা কেউই কখনো করেনা। আমরা যারা ভাড়া থাকি তারাও না! মালিক পক্ষ তো নাই-ই!
কিছুদিন আগে আমার এক শিক্ষক বলেছিলেন- “একজন ইঞ্জিনিয়ারের ভুলের কারনে হাজার হাজার প্রাণ যেতে পারে! কিন্তু একজন ডাক্তারের ভুলের কারনে একটি প্রান! “তাই আমাদের ইঞ্জিনিয়রদের দায়িত্ব অনেক বেশী। আমাদের কাজটি অনেক বেশী গুরুত্ব নিয়ে করতে হবে। সততার সাথে নিজেকে যুক্ত করতে হবে
(আংশিক সংগৃহীত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন