বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৩

বিনষ্ট ও অবলুপ্ত সংস্কৃতি!

অতি সম্প্রতি বারিধারা এলাকায় লুঙ্গী পরে রিক্সা চালানো যাবেনা! কোন চালক যদি ঢুকতে চায় তাকে নিরাপত্তা প্রহরীরা আটকে দিচ্ছে। এই আইন জারি করেছেন আমাদের সমাজের টাকাওয়ালা মানুষগুলু। যারা কোটি কোটি লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করে থাকেন।  কি অদ্ভুত আইন! একজন রিক্সা চালক যিনি নিজের শরীরের ঘাম ঝরিয়ে ১০ -৩০ টাকার দুরত্তে যাত্রী / মালামাল বহন করে থাকে। তাদের জন্য প্যান্ট, হাফ প্যান্ট পরা আইন জারি হয়েছে! নইলে উক্ত এলাকায় বসবাসরত উঁচু মানুষগুলুর মাথা নিচু হয়ে যাবে। তাদের এলাকার নিয়ম ভঙ্গ হয়। পরিবেশ নোংরা হয়। সেই জন্যই এই উদ্যোগ। কিন্তু সেই চালকেরদের জন্য কোন সুযোগ সুবিধার কথা জানতে পারিনি কোন মাধ্যম থেকেই। যেমন: সর্বনিন্ম ভাড়া কতো হবে? কি কি সুবিধা ভোগ করবে?
দৃশ্য -১
একজন রিক্সাচালক রিক্সা চালাবে সেই জন্য কাপড় নির্ধারণ করবে শুধু ধনী মানুষগুলু! এদের ভাগ্য বদলে দেয়ার জন্য একটি সংগঠন করুক । করুক মানুব সেবা! মানব সেবার নামে এনজিও খুলে করছে চুরি জচ্চুরি। খুব নোংরা।
দৃশ্য- ২
সেদিন আমার সন্তান আমাকে প্রশ্ন করে “ আম্মু চুলের রঙ কি ?” । আমি বললাম ” কালো “ ! হেসে বলল তুমি মজা করো! কেন লাকি আপুর চুল যে লাল, মিতু আপুর চুল তো বাদামী , নানুর চুল সাদা, মামার চুল সাদা কালো? হি হি বাবা, তোমার চুল কালো তাই বল চুলের রঙ কালো। বাবা চুল সাদা হয় বৃদ্ধ হলে আর যাদের বয়স কম তাদের চুল কালো। বাকী সব রঙের চুলই হলো আলাদা রঙ করা। চুল রঙ করে আজকাল ছেলে মেয়ে সকলে ফ্যাশন করে।
দৃশ্য – ৩
আবারও সন্তানের প্রশ্ন! আম্মু ঐ যে পাশের বাসার আপু, উনার চুল আর আমার বাবার চুল এক রকম কেন? উনার চুল ছেলেদের মতো করে কাটা কেন? “বয়কাট চুল তাইনা আম্মু?
- বাবা এটা একটি ফ্যাশন! ঐ আপু মনে করে উনাকে ছোট চুলে স্মার্ট লাগে সুন্দর লাগে।
ঐ আপু কখনো তোমার মতো জামা কাপড় পরে না কেন। আমার মতো জিন্স পরে, ফতুয়া পরে কেন? আমি তো বুঝতেই পারিনাই উনি কি ছেলে না মেয়ে! হি হি হি।
-হতাশার উত্তর বাবা আরামদায়ক পোশাক। তাই ঐ আপু জিন্স আর ফতুয়া পরে। এই রকম কাপড় অনেকেই পরে বাবা। আমরা মা হয়ে গেছি তো তাই পরি না।
ঠিক আছে আম্মু, তাইলে বল মিজান  আঙ্কেল এর চুল তোমার চুলের থেকেও লম্বা কেন? কেমন করে ঝুঁটি করে রাখে। সেদিন দেখলাম আঙ্কেল চুল খুলে হাঁটছে। আম্মু তুমি না বল ” ছেলেরা চুল ছোট রাখতে হয় ” এটাই ছেলেদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। আর মেয়েরা রাখবে লম্বা চুল! তাহলে ছেলে মেয়ে সবার চুলে কখনো লম্বা আবার কখনো ছোট ছোট কেন?  উত্তরে কি আর বলবো? বললাম বাবা এটা এই যুগের ফ্যাশন! তুমি বড় হলে হয়ত তুমিও করবে।
দৃশ্য – ৪
সেদিন গুলশান-১ দাঁড়িয়ে আছি সিএনজি ভাড়া করতে। হুট করে সামনে একটি সিএনজি থামল। ভিতরের যাত্রী একজন ২০/২২ বছরের মেয়ে। সে আপন মনে সিগারেট পান করছে! হাব ভাবে ছেলে ছেলে মনোভাব! এটা নতুন দৃশ্য নয়! তবে এই গল্পগুলু আগে শুনতাম না, দেখতেও পেতাম না। গুলশান, বনানী ধরনের ধনী এলাকায় এই ধরনের ফ্যাশন দেখতে দেখতে কখনো লজ্জায় পরি আবার কখনো রাগে ফেটে পরি। কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা নেই। প্রতিবাদে মাইর খেতে হবে ১০০% জানা।
দৃশ্য – ৫
অবাক করা সেন্সরে আটকা পরা দুইটি দৃশ্য। আমি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করি। এবং আমি যেই বিভাগে পড়াশুনা করি ৪০ জন ছেলের মাঝে একমাত্র আপু আমি! এরা সবাই আমার থেকে বয়সে অর্ধেক আবার কেউ কেউ কাছা কাছি! এক কথায় সবাই ছোট।
সন্ধ্যেকালীন পড়াশুনা তাই ভাবলাম একটু ক্যান্টিনে যাই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন ছাদে তৈরি করা হয়েছে। খোলা ছাদে গিয়ে যেই দৃশ্য দেখলাম দুইজন ছেলে মেয়ের সেটার বিবরন এই ব্লগের সেন্সরে আটকা পরে গেল আমার স্বভাবগত কারনে। একগাদা ছেলে, এর মধ্যে কি করে এরা পারে..? এরা এই সব নোংরামির আশ্রয় কীভাবে নেয়।
ছেলে মেয়েদের মধ্যে বন্ধুত্বের ধরন, কথা বার্তা, চালচলন এত বেশি পাল্টে গেছে যে আমাদেরও বন্ধু আছে, ছিল সেই রকমটাই বদলে দিছে এই ডিজিটাল ছেলে মেয়েগুলু!
দৃশ্য- ৬
বেশ কিছু এফএম রেডিও চ্যানেল চালু হয়েছে। যাদের মধ্যে বেশ কিছু অনুষ্ঠান আছে যেমন লাভ গুরু, ভুত এফএম আরও কি কি যেন! এক সময় আমি শুনতাম। বহুদিন হয়ে গেল এসব শুনি না! তবে আমার বাসায় আমার কাজের সহযোগী মেয়েটি শুনে। সেদিন সকালে আমাকে বলছে “ভাবি একটি লোকের জীবন কাহিনী শুনলাম। কি কি ভাবে খারাপ কাজ করেছে তার জীবনে! জানেন ভাবি লোকটা ইয়াহু বাবাও খেয়েছে! আমি থ হয়ে গেলাম। ইয়াহু বাবা! কয়েক সেকেন্ড পর বুঝলাম! ইয়াবার কথা বলছে!
অদ্ভুত তথ্য হলো ইয়াবা যে তরুণ প্রজন্মই সেবন করে তা কিন্তু নয়! আমার জোনা একটি ইংলিশ মাধ্যম স্কুলের শিক্ষিকা বহুদিন যাবত ইয়াবা সেবন করছেন! তার ভাষ্য মতে “ইয়াবা তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, বয়স আটকে রাখে, মেদ ভূরি কন্ট্রোল রাখে, মন ফ্রেশ রাখে” ইত্যাদি ধারালো যুক্তি!
দৃশ্য – ৭
২০১২ সালের শেষের দিকে রাঙ্গামাটি গিয়েছিলাম পারবারিক বাৎসরিক বেড়ানো সূচিতে। অনেক আনন্দ অনেক কিছুর মাঝে পেয়ে গেলাম  সার্কাস। অদ্ভুত লাগলো। আমার জীবনে দ্বিতীয়বার সার্কাস দেখলাম। প্রথম দেখেছিলাম ১৯৮৮ সালের বান্দরবানে। এবার দেখলাম ২০১২ সালে রাঙ্গামাটিতে।
পার্থক্য অনেক। সার্কাস আর আগের মতো নেই! সার্কাসের চমক রেখেছে বাংলা চলচিত্রের কিছু পার্শ্ব নায়ক নায়িকা! যেটা সার্কাস দলের সাথে কোন ভাবেই যায় না। সার্কাস হল সম্পূর্ণই শারীরিক নৈপুন্য প্রদর্শন করার একটি আনন্দঘন শো।  সার্কাস তো এমনি বিলুপ্তির পথে, যাও আছে সেই দলের অবস্থা নাজুক এবং অগোছালো।
দৃশ্য – ৮
হারিয়ে গেছে যাত্রা পালা। যাত্রা পালা টিভিতে মাঝে মাঝে দেখা যায়! কিন্তু বাস্তবের যাত্রাপালা দেখতে যাওয়ার মতো পরিবেশ এখন আর নেই।পথ নাটক, থিয়েটার, স্টেজ শোগুলুর ভিড়ে বিলুপ্ত যাত্রাপালা । এখন যাত্রা শিল্পীদের খুব খারাপ দৃষ্টিতে দেখা হয়!
১৯৮৮ সালে যাত্রা দেখেছি। তারপর আর দেখা হয়নি। ঢাকা শহরে বসবাস করছি দীর্ঘদিন যাবত। কোথাও একটি যাত্রা পালার আয়োজনের কথা শুনা যায় নি!

চলতেই থাকবে …।
সব চেয়ে বিব্রত হই আমি আমার ৮ বছরের ছেলে হাসিন এর কাছে। কারন তার নানা রকম প্রশ্ন ফ্যাশন নিয়া আমাকে মূর্খ করে! আমার বেড়ে উঠা একটি রক্ষণশীল পরিবারে। তেমনি হাসিন ও বেড়ে উঠছে আমার কাছে। তাই তার আজ পর্যন্ত চেনা জানা জগত বলতে মামা, খালা, দাদু, চাচা, ফুফু এবং বাবা ও মাজি (আমার ছেলে আমাকে মা জি বলে)!  স্টাইল ও ফ্যাশন সম্পূর্ণ আলাদা দুইটি শব্দ। এটা আমি আমার সন্তানকে বুঝিয়েছি।
স্টাইল হল যে মানুষটি যুগের সাথে তাল না মিলায়ে নিজের মতো করে কাপড় পরিধান থেকে নিজের জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই চলা চল করে। যে সব সময় টাঙ্গাইল এর শাড়ি, জামদানী শাড়ি, সেলয়ার কামিজ পরা, চুল কালো মেয়েদের ছেলেদের যাদের বয়স কম, লম্বা চুল মেয়েদের, ছেলেদের ছোট চুল ইত্যাদি! স্টাইল সব সময় চিরন্তন সুন্দর, অপরিবর্তনীয় !
ফ্যাশন হল এই যে , যখন যেটা তখন সেটা! সেটা কাপড়ে হোক কিংবা চুলের কাটিংয়েই হোক! কখনো চুল লাল, কখনো বাদামী, কখনো মেয়েদের ছোট চুল, কখনো ছেলের বড় চুল! কখনো মেয়েরা মাসাককালী জামা পরে আবার কখনো দেবদাস শাড়ি পরে, আজকে ধুতি পরছে, কালকে পুরানো হয়ে গেলে ফেলে দেয়া হচ্ছে! ফ্যাশন হল যখন তখন পরিবর্তনশীল !
আমরা পরিবর্তনে অঙ্গীকারবদ্ধ। পরিবর্তন সবার জন্য যুগের সাথে তাল মিলানোর জন্য দরকার। কিন্তু তাই বলে নিজস্ব সংস্কৃতি বিনষ্ট করা ঠিক নয়। নতুন প্রজন্মকে বিপথে ধাবিত করার মানে হয় না। এতে দেশ সমাজ ও পরিবার সকলেই মাশুল গুনে! 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন