বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৩

এই মহানগরীর একজন নারী যোদ্ধার জীবন গল্প!

রেজা সাহেব একজন সরকারী প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা ছিলেন। তার জীবন সঙ্গিনী ৭০ দশকের  উচ্চশিক্ষিতা। তারা ৫ কন্যা ও ০১ পুত্রের জনক জননী। যদিও দ্বিতীয় কন্যাটি মারা গেছে ১৯৯৮ সালে ২৫ বছর বয়সে। রেজা সাহেবও বেঁচে নেই। মেয়েদের মধ্যে এবং সন্তানদের মধ্যেও চতুর্থ হলাম আমি। হ্যাঁ আমি আমাকে নিয়ে বলছি আজ। আমার জীবনের উপর দিয়া বয়ে যাওয়া ঘটনা গুলোর একটা অতি বাস্তব দৃশ্য। পড়াশুনায় বরাবর ভাল ছিলাম। ভাল ফলাফলও করেছি প্রতিবার। বাবার সংসারে ৮/১০ মেয়ের মত নয়, লড়েছি ছেলের মতো করে। জমি চাষ, মাছ ধরা, বাজার করা সব নিজ হাতে হাল ধরেছি। প্রচণ্ড দুষ্ট, মারকুটে ডানপিটে ও ছিলাম আমি।
কিভাবে কিভাবে কেমন করে যেন একদিন এসে অনুভব করলাম বাবা মায়ের ছায়া ভালবাসা আমার পাশে নেই। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে যখন গ্রাম থেকে ঢাকা আসব বড় আপা আমাকে বলে দিল বাসে ওঠে বাইরের সাইন বোর্ড দেখতে দেখতে এলাকা চিনে নিবি। ১৯৯৪ সাল, একা একা বাসে করে চলে এলাম ঢাকা। একটি মাত্র কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। ভর্তি হবার সুযোগও পেলাম। পড়াশুনা শুরু হল। কিন্তু হোস্টেল একমাত্র আমি ছিলাম যাকে কেউ কখনো দেখতে আসতো না। কেবল কলেজ ছুটি হলে আমার মেঝ খালা আমাকে বের করে দিতেন। আবার কখনো মিথ্যে অভিভাবক দিয়ে বের হয়ে বাড়ি যেতাম। পুরো কলেজ জীবনে আব্বা আমাকে হাত খরচ দিতে খুব হিসাব করত। কেবল আমার বেলায়। মেধা তালিকায়  চতুর্থ হয়ে কলেজ পাশ দিলাম। আব্বার সরাসরি আদেশ আমাকে আর পড়াশুনা করাতে পারবে না। কারন ততদিনে আব্বা সরকারী চাকুরি থেকে অবসর গ্রহন করেছেন। কিন্তু আমার আব্বা ঠিকই আমার ছোট দুই ভাই বোন পড়াশুনা করাল। তাতে কি! আমিও খুঁজে নিলাম চাকুরী। বেশ ভাল একটা চাকুরী পেলাম। আস্তে আস্তে ছোট দুই ভাই বোনকে নিজের কাছে ঢাকার বাসায় নিয়া আসলাম। আসলো আমার বড় বোন। আসলো আমার মেঝ বোন। আমি আমার আব্বার বাকি ৪ সন্তানের দায়িত্ব নিয়ে নিলাম। একে একে বড় আপা বিয়ে করে সুদুর আমেরিকা পাড়ি জমাল। মেঝ বোন পড়াশুনা শেষ করে নিজের স্বামী সন্তান নিয়ে থাকা শুরু করলো ঢাকার বাইরে !
পুরো ঢাকা শহরে আমি একা চড়ে বেড়িয়েছি। চাকুরী করেছি তখন আমার বয়স মাত্র ১৮। আমি আমার বাবার ছেলের দায়িত্ব পালন করেছি। আমার আব্বা একটা সময় এসে তো বলত আমি নাকি তার ছেলে! আমাদের গ্রামের সবাই আমাকে দেখলেই বলত ”তুই বেঁচে থাক” তুই যা করলি তোর বাবার জন্য এটা মেয়ে তো দূরে থাক ছেলেরাও করেনা।
আমার মা বাবা আমার প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলা কিংবা ভুল করে থাকলেও তাদের উপর কখনো রাগ কাজ করেনি। অভিমান করে মাঝে মাঝে কাঁদতাম আর বলতাম আমাকে কেন তোমরা পড়াশুনা করতে দিলা না। কেন তোমরা তোমাদের অপারগতা প্রকাশ করলে কেবল আমার বেলায়? আমার ছোট ভাই বোন দুটুকেও তোমরা ঠিকই পড়াশুনা করিয়ে শেষ করলা।
ছোট দুই ভাই বোনকে সাথে করে নিয়ে আমিও বিয়ে করলাম আমার ছোট বেলার বন্ধুকে। আমরা একে অপরকে চিনি জানি সেই ক্লাস সিক্স থেকে। যখন বিয়ে করলাম সে তখনও ছাত্র। ঢাকা মেডিকেল কলেজ পরছে। চূড়ান্ত পরীক্ষা দেয়ার পর আমার বন্ধুটি তার বড় দুই ভাইকে রেখেই আমাকে বিয়ে করে ফেললো ! শুরু হলো অপমান, মানসিক অত্যাচারের, অসন্মানের আরও একটা অধ্যায়।
আমার স্বামী মানুষটি পরিবারের সব চেয়ে ছোট ছেলে এবং দুই ভাইকে টপকে বিয়ে করেছে তাই সে চাইলেও অনেক কিছু বলতে পারে নাই করতে পারেনাই। তবে আমার পাশে ছিল বলেই আমি আজ দাঁড়িয়ে আছি। আমার বাবার অনেক সম্পদ নাই, আমি দেখতেও সুশ্রী নই, উচ্চ শিক্ষিতা নই- এই তিনটি যুক্তি ছিল ওদের কাছে অনেক বড়! আমাকে মেনে নেয়নি আজও! আর কখনোই মেনে নিবে না, সেটাও জানি! আমার স্বামীকে আমার শ্বশুর বাড়ীর লোকজন বলেছিল তুই এই মেয়েকে বিয়ে করেছিস? তোর ভবিষ্যৎ বলে কিছু আর থাকলো না! কেবল একজন এমবিবিএস ডাক্তার হয়েই থাকবি ।
কিন্তু আমার জীবনে বাজী হিসেবে নিয়েছিলাম। স্বামীকে বলেছিলাম বন্ধু আমার দিক থেকে যা যা সাহায্য লাগে বল আমি তোমাকে দিব। তুমি এক লাফে সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হও এটাই আমার একমাত্র চাওয়া। সম্পদ, গাড়ি, বাড়ি, অলঙ্কার চাইনা। চাই তোমাকে একজন সফল ডাক্তার হিসাবে দেখতে। আল্লাহ সহায় আমার স্বামী একটি পরিক্ষাও দ্বিতীয়বার দিতে হয়নি। এফসিপিএস পার্ট- ০১ এক বারেই পাশ করলো। বিসি স একবারেই উত্তীর্ণ হলো। এফসিপিএস চূড়ান্ত পরীক্ষাটাও একবারেই পাশ করে গেল। যারা ডাক্তারদের সম্পর্কে জানেন তারা বুঝবেন মেডিসিন হোক কিংবা যে কোনো বিষয়ে একবারে এফসিপিএস-এর মতো পরীক্ষা পাশ প্রায় বিরল। আমার স্বামীকে আমি কিছু নিয়ে ভাবতে দেইনি। ওর জুতা থেকে শার্ট সব আমি একা একা কিনতাম। টাকা পয়সার জোগান দিতাম।
আমি একটি মেয়ে যে কিনা কখনো গয়না কিনি নি, একটা ভাল শাড়ি কেনার শখ হয়নি। আমার জীবনে একটাই শখ ছিল আছে সেটা হলো আমার স্বামী একজন নামকরা ডাক্তার হবে। আমার সন্তানটি তার বাবাকেই অনুসরণ করবে।
দুঃখকর অধ্যায়টা হলো আমার স্বামী নিজেকে নিয়ে এত বেশি মত্ত ছিল যে, বউ ছেলের দিকে ফিরেও তাকায় নি। আমি অনেকবার আবদার করেছিলাম আমি আবার পড়াশুনা শুরু করতে চাই। পরতে চাই। আমার অসমাপ্ত পড়াশুনাটা আবার শুরু করতে চাই। কিন্তু আমার স্বামী আমাকে সাফ জানিয়ে দিল। তুমি পারবা না! তোমার পক্ষে এই বয়সে এসে পড়াশুনা করা সম্ভব না! অনেক অনুনয় বিনয় করে কেঁদে কেটে রাজি করাতে ব্যার্থ হয়ে অসফল হয়েছি সত্যি, তবুও আমি থেমে থাকিনি।
একদিন ঢাকা শহরের সকল বেসরকারি বিশ্ব বিদ্যালয়গুলোয় খোঁজ নিলাম। চাকরী করার পাশাপাশি আমি কি করে আমার স্নাতক ডিগ্রিটা সমাপ্ত করব? একজন সহকর্মীকে সহায়তায় খুঁজে পেলাম। তিনিও ওই বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ছাত্র। আমি ভর্তি হয়ে গেলাম। সংসার, অফিস, পড়াশুনা সব মিলেই আমি হাঁপিয়ে উঠছিলাম, পারছিলাম না। আমার স্বামী আমাকে আটকে রাখেনি তখন। তবে সাহায্যও করেনি। আমার এক বড় ভাই আমাকে সাহায্য করেছে। যার মূল্য আমি কখনো দিতে পারব না। উনি আমাকে সাহস যোগায়ে দিয়েছেন। বলতেন তুমি এগিয়ে যাও তুমি পারবে আটকাবেনা। আমি আসলেই আটকাই নাই। তবে ক্লান্ত হয়েছি। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে মনে হতো নাহ্‌ ছেড়ে দেই পড়াশুনা!
আমার সঙ্গে যারা পড়াশুনা করছে তাদের মধ্যে মাত্র তিন জন নারী ছিলাম, বাকি ৩৫ জন ছিল পুরুষ। সব মেয়েগুলোই আস্তে আস্তে চলে গেল। রইলাম আমি একজন নারী আর ২০/২৫ জনের এক দল ছেলে ছাত্র। যাদের মধ্যে আমাকে খুব বেশী সহযোগিতা করেছে কয়েকজন। যাদের বয়স আমার বয়সের ঠিক অর্ধেক। মাঝে মাঝে ওদের সাথে মজা করতাম যে, আমি তো তোমাদের মায়ের বয়সী । আমার শিক্ষকরাও বেশিরভাগ আমার থেকে বয়সে ছোট! কয়েকজন শিক্ষক তো আমাকে দেখে অবাক হয়েছেন। বলেছেন আপনাকে দেখে অগ্নিশিখার মতো মনে হয়! আমার বিশ্ববিদ্যালয়য়ের বাকি ছাত্র-ছাত্রীরাও আমাকে দেখে অবাক হতো, আর বলতো আপা এই বয়সে আপনি কেন এত কষ্ট করছেন? কি দরকার? স্বামী ডাক্তার শুনলে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় সবার। পড়াশুনা কি কেবল চাকরী আর বিয়ে করার জন্য? আমি যেই চাকরিটা এখন করছি সেটা আজও অনেক ভাল চাকরি। নতুন ডিগ্রি চাকরিক্ষেত্রে কাজে না লাগলেও আমার মনের জোর বাড়িয়ে দিল অনেক খানি।
আমার পরাশুনার আগ্রহ ও পরীক্ষার ফলাফলে আমার স্বামী সন্তুষ্ট এবং একটা সময় আমাকে সাহস যোগাতে শুরু করলো। একদিন হুট করে এটাও বলল, তোমাকে আমি বিদেশ থেকে পড়াশুনা করায়ে আনব। আর মাত্র ক’মাস পর আমি একজন পুরকৌশলী হব ইনশাল্ললাহ! আগামি বছর ইনশাল্লাহ মাস্টার্সটাও শুরু করে দিব। আমি আমার স্বামীকে গতকাল রাগ করে বললাম, আমি পাশ করার পর সনদপত্রের ফটো কপি করে তুমি সত্যায়িত করবা। এবং যারা যারা আমাকে আমার শিক্ষা নিয়ে অপমান, মানসিক নির্যাতন করেছে তাদের গিয়ে বলবা এই নেন আমার বউয়ের এর স্নাতক সম্পন্ন করার সনদের কপি। যেটা আমি সত্যায়িত করেছি। ও পাশে ছিল বলেই আমি বিসিএস পাশ করে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা। আমার বউ আমার তো নয়ই অন্য কারও কখনো বোঝা হয়নি। উল্টো সবার উপরে উঠার সিঁড়ি হয়েছিল। একটা সনদপত্রের জন্য আমি যে কি পরিমান লাঞ্চিত অপমানিত হয়েছি সেটা আমি জানি।
আব্বা বেঁচে নেই। আম্মা দেশে নেই। আম্মা আছেন বড় বোনের কাছে আমেরিকা। আমার ছোট দুই ভাই বোন এখনো আমার কাছে আমার পাশে বাস করে।
আমি নিজেকে নিজে সফল করেছি। আমার চারপাশ এখন অনেক গুছানো পরিপাটি হয়ে আসছে। কিন্তু ততদিনে যে আমার সময় হয়ে গেছে চুলে কালো রঙ করার আর পুরানো দাঁত ফেলে দিয়ে কৃত্রিম দাঁত লাগানোর। অনেক কিছুই বদলালো। কেবল বদলালো না আমার শ্বশুর বাড়ীর মানুষগুলো। এটা আমার স্বামী, বন্ধু অপুও স্বীকার করে। অসহায়ত্ব প্রকাশ করে। কি করবে ওর মা বোন ভাই বলে কথা! কিন্তু তাতে কি! আমার স্বামীতো আমার পাশে আছে। আছে আমার সাহস। আমি কর্মঠ। আমি ভীত নই। আমি থামবো না।
তারপরও আমি সুখী, খুশী। অবশেষে আমি সফল। এখন আমি সকলের গর্ব। অনেকের আদর্শ।
অনেক ধন্যবাদ আমার বাল্য বন্ধু আমার সন্তানের পিতা আমার ভালোবাসার মানুষ ডাক্তার অপু’কে। আমার স্বামীর মনোভাব উদার না হলে, আমাকে এত বড় একটা সুযোগ না দিলে, আমি এতগুলো ছেলের মাঝে একমাত্র মেয়ে হলে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে কখনোই পারতাম না। আমার স্বামী একজন আদর্শ স্বামী একজন আদর্শ ডাক্তারও বটে। আমাদের দেশে মেয়েদের এত স্বাধীনতা দেয় কয়জন স্বামী? তবে আমার স্বামী আমাকে পুরো  স্বাধীনতাটাই দিয়েছিল। আমার অপু আমাকে কথা দিয়েছে আমাকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করাবে। আমার ছোট বোন মুন, আমার আম্মা, আমার ছোট ভাই, আমার ক্লাসের সকল ছোট ছোট ছেলেগুলোকে বিশেষ ধন্যবাদ। পল্লব ভাই আপনাকে, আপনি আমাকে বলেছিলেন সুধা তুমি পারবে। ভয় পেও না পিছিয়ে যেও না। কষ্ট করে শেষ কর পড়াশুনাটা। একদিন তুমি তোমাকে অনেক শক্ত, অনেক সন্মানীয় করে তুলতে পারবা যারা তোমাকে অপমান করেছে অসন্মান করেছে। তুমি কারও বোঝাও না দায়িত্বও না। তোমাকে দেখে অন্যরা শিখবে।  ভাইয়া আপনি আমাকে একটা নতুন আলোর জগতে আসার অসীম সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছেন। আপনার কথাগুলো আমি কখনো ভুলিনি ভুলব না। আপনি আমার বড় ভাইয়ের মতো, আমাকে দূর থেকে যেভাবে সাহায্য করেছেন সেটা অবর্ণনীয়।
বিশ্ব নারী দিবসে আমি আমার সংগ্রামী জীবনের ঘটে যাওয়া, বয়ে যাওয়া অধ্যায়গুলো থেকে একটু বললাম। নারীদের সাহস যোগাতে। নারীদের পাশে এসে দাঁড়াতে। আমি কাজ ভালবাসি, আমি মানুষ ভালোবাসি। আমি দেশ ভালোবাসি। আমি সকলকে শ্রদ্ধা করতে পারি। আমি দুর্বলকে টেনে তুলি, সবলকে এগিয়ে যাওয়ার উদ্যম যোগান দেই। নারী বলে নিজেকে গুঁটিয়ে না রেখে বাইরে বের করে আনা প্রতিটি নারীর নৈতিক ও সাংবিধানিক অধিকার এবং নিজেদের একটা জগত তৈরি করা দরকার।
আমি সব সময় বলি, বলতে ভালোবাসি : MY DAILY LIFE IS NOT CAREER….IT IS MY LIFE STYLE…..
আমি একজন সফল নারী। সফলতা সকল ক্ষেত্রেই আজ আমার। এখন একটাই লক্ষ্য একজন সফল মা হতে চাই। সন্তানকে প্রতিদিন এটাই দেয়ার চেষ্টা করছি। এই নিরব সফল যোদ্ধা যেন জীবনের এই যুদ্ধেও সফল হই সেজন্যে সকলের দোয়া, সহযোগিতা, উপদেশ কামনা করছি !
আমিও পেরেছি সকলেই পারবে। নারী দিবসে সকলে অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন